শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০১:১৫ অপরাহ্ন

১৫ আগস্ট বাঙালির শোকাবহ দিন – মো.আব্দুল মালিক

১৫ আগস্ট বাঙালির শোকাবহ দিন – মো.আব্দুল মালিক

১৫ আগস্ট বাঙালির শোকাবহ দিন - মো.আব্দুল মালিক

১৫ই আগস্ট বাঙ্গালির এক শোকাবহ দিন
মোঃ আব্দুল মালিক


১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে এমনই একটি বেদনাদায়ক দিন- যা বাঙ্গালি মাত্রই এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারে না। এদিন এদেশীয় কিছু কুলাঙ্গার তাদের পাকিস্তানি প্রভুদের প্ররোচনায় তথা পলাশীর প্রান্তরের সাজানো নাটকের কুশীলবদের উত্তরসূরিরা যে ঘটনা ঘটিয়েছিল সভ্যতার ইতিহাসে তা রীতিমত অকল্পনীয়। এ ঘটনাটি এতই বর্বরোচিত, নৃশংস ও অমানবিক ছিল যে, যার তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া বিরল। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক রাষ্ট্রনায়ক আততায়ীর হাতে, সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন, কিন্তু শিশু ও মহিলাসহ পরিবারের সকল সদস্যকে নির্বিচারে হত্যার ঘটনা সম্ভবত এঁটাই প্রথম। তাই এ জঘন্যতম ঘটনার দায়ভার, লজ্জা বাঙ্গালি জাতিকে কাল থেকে কালান্তরে বয়ে বেড়াতে হবে।

তারা এইদিন বাঙ্গালি জাতির কান্ডারিকে খুন করে জাতিকে অভিভাবকশূন্য করার অপপ্রয়াসই শুধু চালায়নি, সেইসাথে সেই মহাবৃক্ষের শেকড়শুদ্ধ উৎপাটনের উদ্দেশ্যে চালিয়েছিল একের পর এক স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ার। বাঙ্গালির কষ্টার্জিত অর্থে কেনা গোলাবারুদ যেখানে বহিঃশত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে ব্যবহারের কথা, সেখানে তা ব্যবহৃত হয়েছে একটি পরিবারের কনিষ্ঠতম ফুলের মত কোমল শিশুকে নির্মমভাবে হত্যার কাজে।


পাকিস্তানি হায়েনারা নির্মম ছিল, বর্বর ছিল, পিশাচ ছিল। সর্বোপরি তারা দুপেয়ে মানুষ হলেও তাদের মধ্যে মনুষ্যত্বের কোনো রেশ ছিল না। কারণ তাদেরকে পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশকে মানবশূন্য করতে। বাংলার পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ভূখন্ডকে মহাশ্মশানে পরিণত করতে। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের দোসর টিক্কা খান সদম্ভে সেকথাই ঘোষণা করছিল পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালি নিধনে অংশ নেওয়া সৈনিকদের উদ্দেশ্যে, ‘আমি বাংলার মানুষ চাই না, মাটি চাই।’ ১৫ই আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নমনি, হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি ও তাঁর পরিবারকে হত্যার উদ্দেশ্যে এদেশীয় টিক্কা খানরা যে নির্দেশ দিয়েছিল তার উদ্দেশ্যও ছিল অভিন্ন, ‘ মানবশূন্য বত্রিশ নম্বর বাড়ি চাই।’ সে কাজটিই অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে করেছিল পঁচাত্তরের কালরাতে ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে অংশ নেওয়া মানবরুপী দানব সৈনিকরা, বাঙ্গালি নামধারী নরাধমরা।


মানুষ হতে হলে মানুষের মধ্যে কিছু হুঁশ থাকা চাই আর এই হুঁশটা যদি না থাকে তাহলে সে তো মানুষ নামের খোলস মাত্র- তাকে রোবটের সাথেই তুলনা করা যেতে পারে। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু সৃষ্টির সেরা জীবেরা যখন সৃষ্টি জগৎকে নরকে পরিণত করার কর্মকান্ডে লিপ্ত হয় তখন তারা পরিগনিত হয় কীট হিসেবে। সে কীট মানুষের কোনো কাজে আসা দূরে থাক, নিয়ত ক্ষতির কারণই হয়ে থাকে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে পঁচাত্তরের খুনিরা মানুষতো নয়ই- সৃষ্টির অধম কীটের সাথেও তুলনার অযোগ্য।

তারা একটি জাতির পিতাকেই শুধু হত্যা করে নি, হত্যা করেছে একটা পুরো জাতিকে, বাঙ্গালি জাতির আশা- আকাঙ্খার প্রতীক, ভবিষ্যতের পথ চলার পাথেয়- জাতির কান্ডারিকে। তারা শুধু এ কাজটি করেই ক্ষান্ত হয় নি, তারা একের পর এক নারকীয় হত্যাকান্ডে মেতে উঠে। এ যেন মানুষ হত্যার মহোৎসব। তারা হত্যা করে বঙ্গজননী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে। হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি দুই পুত্র মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল ও শেখ জামালকে। হত্যা করে দুই পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও পারভীন জামাল রোজীকে। তাদের বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের শিকার হন বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের , নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল শাফায়াত জামিল, কয়েকজন পুলিশ সদস্য ও ব্যক্তিগত কর্মচারী।


বত্রিশ নম্বর রোডের বাড়িতে যখন এ নারকীয় তান্ডব চলছিল তখন আট বছরের একটি শিশু থরথর করে ভয়ে কাঁপছিল। তার নাম শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধু পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য। একটা নয় দুটা নয়, দু’চার, দশটাও নয় এরা নরাধম পিশাচের চেয়েও ভয়ংকর আক্রোশে স্টেনগানের ব্রাশফায়ারে বঙ্গবন্ধুর বিশাল মাপের বুকটা ঝাঁঝরা করে দেয়।

এ বীভৎস চিত্র দেখে ছোট শিশু রাসেল বুক চাপড়িয়ে আহাজারিতে মায়ের হাত ধরে মুখ লুকোবার জন্য মায়ের আঁচল খুঁজছিল। সেই মুহুর্তে খুনিরা তার সামনেই তার প্রিয় মাকে হত্যা করে। নিজের চোখের সামনে বাবা মায়ের স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে ঝাঁঝরা মুখ ছোট শিশুটির মনে কী ধরনের রেখাপাত করেছিল তা ভাববার বিষয়। বাপ-মা হারা শিশুটিকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একজন পুলিশ অফিসার অনেক অনুনয় বিনয় করেছিল। বিনিময়ে তার ভাগ্যেও জুটেছিল ব্রাশ ফায়ার।


মাকে হারিয়ে মায়ের ক্ষতবিক্ষত শরীরের উপর লুটিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদছিল রাসেল। জল্লাদরা তাকে টেনে হিচড়ে মা’র কাছ থেকে আলাদা করলে রাসেলের মুখে করুণ আকুতি ঝরে পড়ল, ‘আমাকে মেরো না, আমি কোনো অন্যায় করি নি।’ কিন্তু ঘাতকের কর্ণকুহরে জাতির পিতার এ মাসুম শিশুটির আবেদন পৌঁছালো না। কারণ তারাতো মানুষ ছিল না- ছিল পিশাচ।
এরপর রাসেল এক দৌড়ে বড় ভাবি সুলতানা কামালের কাছে আশ্রয় নেয়। সুলতানার পাশে ছিলেন ছোট ভাবি রোজী। তারা দুজনই মাসুম শিশুটিকে বুকে আগলে রেখে থাকে রক্ষার প্রণান্তকর প্রয়াস চালান। কিন্তু ঘাতকেরা কাউকেই ছাড়বে না।

এক এক করে সবাইকে সরিয়ে দেবে এ পৃথিবী থেকে। তার পরক্ষণেই তারা বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধুকে একত্রে হত্যা করে। একের পর এক মৃত্যুর মিছিল আর বিভীষিকায় হতবিহ্বল রাসেল এবার ঠাই খুঁজে বেড়ায় বাড়ির কাজের লোকজনের কাছে। বাড়ির কাজের লোকজনকে জড়িয়ে কান্নারত রাসেলকে টেনে অন্যত্র নিয়ে যায় একজন মেজর। আট বছরের একটা শিশুর প্রাণবধের জন্য উপরে তুলে একটা আছাড় অথবা বন্ধুকের একটা সজোরে গুঁতো কিংবা বেয়োনটের একটা খোঁচাই তো যথেষ্ট।

কিন্তু না, তারা এ অবুঝ শিশুটিকে এত বেশি ভয় পাচ্ছিল, যদি না শিশুটি কোনোরকমে বেঁচে যায় তাহলে তো তাদের সাত পুরুষের ভিটেয় ঘুঘু চড়বে। তাই তারা মরিয়া হয়ে উঠে বাংলাদেশের ভাবীকালের শিশু নিধনে । তারা এ কচি প্রাণটার ওপর একটা, দুইটা নয়, বেশ কয়েকটা গুলি চালায়। মুহুর্তে ৮ বছরের নিষ্পাপ শিশুটি জান্নাতের সিঁড়ি বেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসে পৌছে যায়।


কী দোষ ছিল এ মাসুম শিশুটির। কী দোষ ছিল বাংলার বুকে তার প্রিয়তম পিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের । একটি স্বাধীন ভূখন্ড, একটি লাল সবুজের পতাকা, একটি আলাদা পরিচয়, একটি জাতীয় সংগীত ও সর্বোপরি একটি সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার পুরস্কার কি এই বুলেট? পুত্রের সামনে পিতাকে অমানবিক ও বর্বরোচিত কায়দায় হত্যা।

একজন মানুষের প্রাণস্পন্দন থামিয়ে দিতে কয়টা গুলি প্রয়োজন? আজ বড়ো প্রয়োজন এসব নিয়ে ভাববার, আজকের প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড নিয়ে যতই বিচার-বিশ্লেষণ করবে তাতে করে খুব সহজে স্বাধীনতার আসল শত্রুর মুখোশ আমাদের চোখের সামনে স্বচ্ছ আয়নার মতো প্রতিভাত হবে।


১৫ই আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের পর্যায়ে উন্নীত করতে, জঙ্গীমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে এক যোগে কাজ করতে হবে এই হোক আজকের সকল বাঙ্গালির অঙ্গীকার।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD