শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৪৯ পূর্বাহ্ন

মায়ের জন্যে এই সকাল – দিলারা হাফিজ

মায়ের জন্যে এই সকাল – দিলারা হাফিজ

মায়ের জন্যে এই সকাল:
দিলারা হাফিজ

মায়ের জন্যে বুকভারা হাহাকার নিয়ে ঘুম ভাঙলো আজ।
ভাবলাম আজ পনেরো দিন মাকে ছেড়ে সন্তানদের কাছে এসেছি—মাকে একবারও কল দিইনি—বাংলাদেশের ওপাশ থেকে মাও তো বলেনি, কত দিন হলো গেছো,ফোন দিচ্ছো না যে তুমি, আমি কত চিন্তায় আছি,বুঝতে পারো?

এতদিন, সত্যি সত্যি বুঝতে পারিনি মা।
এখন বুঝতে পারছি স্বামী-সঙ্গীহীন তোমার প্রথম সন্তানটিকে নিয়ে বড্ড বেশি দুঃশ্চিন্তা ছিলো তোমার।
আমি দু’দিন কল না দিলেই কেন এত উতলা হতে। এখন খুব বেশি বুঝতে পারছি মা।
করোনার জন্যে এদেশে সন্তানদের অফিস ঢুকে গেছে ঘরের মধ্যে।পানির কল ছেড়ে এক গ্লাস পানি পান করতে হলে পরবর্তী মিটিংএর বিরতির সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো।একথা তো বলিনি তোমাকে, শুনলে তুমি খুব কষ্ট পেতে।তাই না?
এজন্যেই তোমার কাছে কল যেতে কখনো কখনো
২/১ দিন দেরী হতো। প্রতিদিন আমার ফোন না পেলে তুমি হয়তো ভাবতে যে,আমার শরীর খারাপ হয়েছে, আমি মনোকষ্ট যাপন করছি, কিংবা খুব বেশি বেদনাবিভোর,
শব্দহীন নিমজ্জনে জীবন থেকে সুদূরে সরে আছি আমি।
তখন নিজেই তুমি কল দিয়ে আমাকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনতে।
শরীর খারাপ থাকা সত্ত্বেও আমার মন ভালো রাখার জন্যে বলতে, ‘আমি ভালো আছি’।
এখনি মরবো না,আরো অনেক দিন বাঁচবো,চিন্তা করো না।
তুমি তো জানতে, তোমার শরীর-মন ভালো থাকবার এই খবরটি শুনলে—এদেশের ম্রিয়মান আবহাওয়া সত্ত্বেও দিনটি আমার শরৎ আকাশের মতো হেসে উঠতো খল-বলিয়ে।
তাই বানিয়ে বানিয়ে ভালো থাকার সংবাদ পরিবেশন করেছো এদেশের জন্যে।
রফিক আজাদকে হারিয়ে আমি যে বড্ড বেশি নিঃস্ব এবং একাকীত্ব্রের কষ্টে আছি—সে খবর তুমি ছাড়া সেভাবে কে আর বুঝতো,বলো মা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরে সেই ফাস্টইয়ারের শেষের দিক থেকেই তো আব্বা এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনেরা বিয়ের জন্যে চাপ দিয়ে যাচ্ছিলো আমাকে। একমাত্র তুমি ছিলে নিশ্চুপ। তোমার এই মৌনতা ছিলো জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পথে আমার এগিয়ে যাবার নিরলস সাহস ও দুর্বার শক্তি।
বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে বলে পাড়া-প্রতিবেশির ঘুম নেই চোখে।কিন্তু তুমি তোমার কন্যা সন্তানের প্রতি সুগভীর আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের সুতোটি ছেড়ে দিয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছো। তোমার কোনো বিকার নেই, তুমি তখনো স্বপ্নে বিভোর তোমার সন্তান অনেক বড় হবে। তুমি যা যা হতে চেয়েছো,কিন্তু সুযোগ ও সহাযোগিতার অভাবে হতে পারোনি—তার সবটুকু তুমি তোমার প্রথম কন্যা-সন্তানের মধ্যেই দেখতে চেয়েছিলে। তাই তো এত এত প্রতিকূলতায় তুমি মৌন ব্রত পালন করে যেতে পেরেছিলে দিনের পরে দিন।হায় রে ধৈর্যশীল ও সাহসী মা আমার।
এ জগতে একবারই এমন একজন মায়ের দেখা পাওয়া যায়! বার বার নয়।
সকল সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে তোমার নিজ উদ্যোগে মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছো বলে ঐ অজো পাড়াগাঁয়ের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ থেকে কত কুকথা শুনতে হয়েছে তোমাকে। তুমি সেসব কথা অমৃত ভেবে নিমিষে হজম করে ফেলেছো।মায়ের জন্যে এই সকাল - দিলারা হাফিজ
কোনোদিন তার সামান্য আঁচও তুমি আমাকে পেতে দাওনি। মুখ ফুটে আমাকে জিজ্ঞেসও কোনোদিন করোনি যে,বিয়ে করবে কবে?
যেদিন প্রথম সাপ্তাহিক একটি পত্রিকায় ছবিসহ রফিক আজাদের সাক্ষাৎকারটি দেখিয়ে বলেছিলাম,মা, আপনি যদি রাজি থাকেন, তবে আমি এই কবিকে বিয়ে করতে চাই।
দু’চার কথায় তার অতীত বর্তমান সম্পর্কে সামান্য ধারণা দিয়ে শুধু বলেছিলাম—-এই কবিকে আমি ভালোবাসি,মা।
তুমি আমার মুখপানে চেয়ে এক কথায় রাজি হয়েছিলে সেদিন।
দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে আমার আব্বার সম্মতি পেতে সময় লেগেছিলো দু’দিন।কিন্তু তুমি আমাকে সম্মতি দিয়েছিলে’ভালোবাসি’ শব্দটি শ্রবণমাত্রই।ছোটবেলায় বাবা হারানো সর্বশেষ কন্যা তুমি, নিজেও তো ছিলে ভালোবাসার কাঙাল।
যে মানুষটির জন্যে প্রাণ-মন সদা উদগ্রীব হয়ে থাকতো, যার প্রতি এত গভীর ভালোবাসা ও মধুর আকূতি সর্বক্ষণ বর্তমান—-সেই মানুষটিকে ছেড়ে তোমার সন্তান কেমন থাকতে পারে—-একমাত্র তুমিই তা বুঝতে পারতে মা।
সেজন্যে আমার পুরোনো ঘর-বিছানা উপড়ে ফেলে দিয়ে নিজের কাছে, নিজের খাটে আমার শয়নের ব্যবস্থা করেছিলে মা।
তোমার মতো মমতাময়ী সর্বংসহা মা-জননীর সর্বশেষ শর্তহীন ভালোবাসার সেই আশ্রয়টুকু হারিয়ে বড্ড বেশি অস্থির,অসহায় বোধ করছি মা। আমি এখন এদেশের পথে পথে হাঁটি আর তোমার মধুর মূরতি আঁকি মা।
আমাকে বুঝতে পারার কেউ রইলো না এই নির্মম পৃথিবীর প্রান্তে।
তুমি আমার সকল কিছু শূন্য করে দিয়ে গেলে মা।
মা, মাগো, তোমার চলে যাওয়া মানে—
নিষ্ঠুর,নির্দয় এই পৃথিবী যেন ভালোবাসাহীনতার নির্মম এক উদ্যান।
মা,
তুমি ছিলে আমার আনন্দ পারাবার।
তুমিই দুঃখ আজ,তুমিই কষ্টের নুড়ি,
পরিমাপহীন তুমি বিষাদের বিরান-ভূমি;
আমার বুকে অথৈ দুঃখের সাগর।

ক’দিন আগেও তুমি ছিলে আমার প্রতিদিনের ঈদের পোশাক,
হাত বাড়ানো খুশির চাঁদ,
আমিও ছিলাম একদিন তোমার হাতে
অবনীসোনার মতো এক অলৌকিক মনোবীণা,
তোমার বুক খুঁড়ে খুঁজে পেয়েছিলাম অমৃতের দুগ্ধস্রোত…
একদিন ছিলে তাই শান্তির পারাবার।

তুমি আজ নবরূপে রোপিত বিষাদ…

৬/৯/২১
মিউজিক পার্ক, টরন্টো

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD