দিনের কড়চা ৮০
বৃহস্পতি যখন তুঙ্গে
মেট্রো এলো বঙ্গে
দৃশ্যটি কল্পনা করুন। মেঘনার চরে এসে আঁটকে আছে এক সুদৃশ্য সমুদ্রগামী জাহাজ। বিদেশি সে জাহাজ দেখতে চরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে মানুষ। ঠিক একই ব্যাপার ঘটছে ঢাকার মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসছে এই অত্যাশ্চর্য রেল দেখতে। এখন যত লোক মেট্রোরেলে চড়ে তার সিংহভাগ আসে মেট্রো দেখতে।
কাল বিকেলে বৃহস্পতি আড্ডার সদস্যরাও গেল মেট্রোরেল দেখতে। এই লেখক দলটির বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। তুঙ্গে থাকার কারণ দলনেতা রোকেয়া ইসলামের মাথায় নিত্য নতুন সব ভ্রমণ পরিকল্পনা ঘুরতে থাকে। এই কবি ও কথাসাহিত্যিক সর্বদাই ভাবেন কী করে সভ্যদের আনন্দিত রাখা যায়। অনুষ্ঠান, আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া, সিনেমা দেখা, ভ্রমণ – ইত্যাকার নানা আয়োজনে তিনি তাদের মাতিয়ে রাখেন, চঞ্চল করে তোলেন, তাদের পায়ের তলায় ছড়িয়ে দেন সর্ষে। তারা ভুলে যায় তাদের অগ্রগামী বয়স, শরীরের নানা অস্থিসন্ধিতে বাধা জট; তারা ছোটে সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত তরুণীর মতো। এই ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য রোকেয়া ইসলাম বানিয়েছেন ‘ঘোরাঘুরি আনন্দ আয়োজন’ নামের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপ। এই গ্রুপে সদস্যদের ঘোরাঘুরির উৎসাহ দেখলে মনে হয় তারা সকলেই ঘোড়ার উপর চড়ে আছেন, দলনেতা হুইশল বাজালেই ছুটতে থাকবেন।
কাল হুইশল ছিল মেট্রোরেলের আগারগাঁও স্টেশনে জড়ো হওয়ার। বিকেল (রাত নয়) পৌনে চারটায় স্টেশনে জড়ো হওয়া, চারটায় ট্রেনে চড়া- এই ছিল দলনেতার নির্দেশ। কবি-লেখকদের অনেকেই থাকেন মিরপুর অঞ্চলে, যে অঞ্চলে জর্ডানের চেয়ে বেশি লোক বাস করে। শুধু জর্ডান কেন, পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ দেশে অত লোক নেই। তবে মিরপুরে থাকলেই যে তারাই সবার আগে মেট্রোরেলের যাত্রী হবেন তা বলা যায় না। বরং আমি স্টেশনে পৌঁছে দেখলাম দুই কবি হাসিদা মুন ও পারভীন শাহনাজ ইতিমধ্যে সেখানে উপস্থিত। এরা মিরপুরের বাসিন্দা নন, হাসিদা মুন থাকেন ধানমন্ডি, পারভীন শাহনাজ রামপুরা। তৃতীয় যিনি এলেন সেই কবি শিমুল পারভীনও থাকেন ধানমন্ডি। আমি যদিও মিরপুরের অধিবাসী, এসেছি তো আফতাবনগর থেকে।
চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে তিন ললনাকে পেলাম। তারা দাঁড়িয়েছিল টিকেট কাউন্টার আর উপরের প্লাটফর্ম যাবার টিকেট মেশিনগুলোর মধ্যবর্তী অঞ্চলে। দলনেতা রোকেয়া ইসলামকে সামলাতে হচ্ছে পুরো দলকে, তিনি কম্পিউটার সিটির পাশে যে শেরে বাংলা গার্লস স্কুল সেখান থেকেই বয়স্কা বালিকাদের সাথে যোগাযোগ রাখছিলেন। তার লক্ষ একজনও যেন বাদ না যায়। এদিকে তাকে বরণ করে নেবার জন্য পুষ্পস্তবক হাতে দাঁড়িয়ে আছে হুমায়ুন কবির ও পুলিশের এক সাব ইনস্পেক্টর মিন্টু মিয়া। নিচ থেকে রোকেয়া আপার নির্দেশ এলো ‘কামরুল, আপনি দশটি টিকেট কেটে ফেলুন।’ আমি তখন আটকে আছি তিন সুন্দরীর ফটোসেশনে একমাত্র চিত্রগ্রাহকের ভূমিকায়। সেসব রূপমোহজাল ছিন্ন করে যাই টিকেট কাউন্টারে। আগারগাঁও থেকে উত্তরা উত্তর মেট্রোরেলের ভাড়া ৬০ টাকা। ৬০০ টাকায় দশ টিকেট কিনে তিন সুন্দরীর হাতে দিলে তারা তরতর কর চলে যায় উপরের প্লাটফর্মে। নিচের ভ্যাপসা গরম থেকে মুক্তি পেতেই তারা বোধকরি উপরে গেল যদিও সেখানে কোনো শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নেই। এখন বেগম রোকেয়া সরণী বেয়ে প্রবাহিত শীতল বাতাস যদি এই তিন রোকেয়া ( বেগম ও ইসলাম) শিষ্যাকে কিছুটা স্বস্তি দেয়। যাবার আগে তাদের হাতে ফুল গুঁজে দিল মিন্টু মিয়া।
রোকেয়া ইসলাম উপরে উঠে এলেন বোন স্বর্ণা ইসলাম ও বান্ধবী লুৎফুন নেসাকে সঙ্গে নিয়ে। সেখানে আগেভাগেই ছিলেন অগ্রজ কবি মুশতারী বেগম, বৃক্ষপ্রেমী মামুনুর রশীদ ও প্রকৃতিমুগ্ধ আফরিন আশা। আরও আগে এসেছিলেন তারিক মিঠুল ও তার সহধর্মিণী।
এবার ঘটা করে পুষ্প অর্পণ আর ফুল নিয়ে দলবদ্ধ ছবি তোলা হলো। লুৎফুন নেসার জন্য টিকেট কাটতে ফের দাঁড়ালাম লাইনে। এমনি সময়ে দেখতে পেলাম রোকেয়া আপার আরেক বোন নিলুফা ইসলামকে। সূর্যমুখী রঙের শাড়িতে তাকে সূর্যমুখীই মনে হলো ওই মেট্রোবাগানে। পূবের কাচের জানালায় তখন সূর্য যদিও আর নেই। বর্ষার জলবহুল এক আকাশে সে তখন পশ্চিমের মেঘমালার সাথে লুকোচুরি খেলছে।
দুপুর যত বিকেলের দিকে গড়াচ্ছে তত বেড়ে উঠছে ভীড়। তত চরের মানুষ ছুটে আসছে আধিভৌতিক রাতে পূর্ণিমা ছাওয়া চরাচরে এক অলৌকিক স্টিমার দেখতে। স্টিমারের নাম মেট্রোরেল!
(চলবে)
Leave a Reply