শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১১:২৮ অপরাহ্ন

আসুন আত্মসমালোচনা করি – এ বি এম সোহেল রশিদ

আসুন আত্মসমালোচনা করি – এ বি এম সোহেল রশিদ

আত্মসমালোচনা

আসুন পরচর্চা না করে আত্মসমালোচনা করি। বাড়িয়ে দেই বন্ধুত্বের হাত। একটু কষ্ট করে পড়ুন।

গুজবের জন্ম অনেক অনেক কাল আগে। লিখিত ইতিহাসে ৫১৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ইরানের বহিস্তান শিলালিপিতে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ভারতের পণ্ডিত চাণক্য (৩৭১-২৮৩ খ্রিষ্টপূর্ব) এই ‘উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রচার’ নিয়ে খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তাঁর জীবদ্দশায় আলোচনা করে গেছেন বিস্তর। প্রায় প্রতিটি দেশ নিজেদের প্রয়োজনে গুজব ছড়িয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার তৈরি করেন বিশেষ মন্ত্রণালয়। নাম দেন ‘মিনিস্ট্রি অব পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা’। আর এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন তারই প্রিয়ভাজন গোয়েবলসকে।

একই ধারাবাহিকতায় সাহিত্য সংগঠন, সংগঠক কিংবা কবি বা লেখকের সম্মানহানি বহুদিন ধরেই হয়ে আসছে। এদের হাত থেকে রবীন্দ্রনাথ নজরুলও বাদ পড়েননি। নিন্দুকেরা তাদের কলমের হলুদ ভাবনায় কালিমাময় করতে চেষ্টা করেও পারেনি। তবে তখন এগুলো করতেও যোগ্যতা লাগতো। প্রচার মাধ্যম কম ছিল আর এখনকার মতো সহলভ্য ছিল না। এখন যা হচ্ছে বা যারা করছেন তারা শুধু যে নিজেদের নিম্ন রুচির পরিচয় দিচ্ছেন তা শুধু নয়, যে বিষয়ে কথা বলছেন সে বিষয়ে ন্যূনতম ধারণাই নাই। তথ্যভিত্তিক নয় তাদের উপস্থাপিত অভিযোগগুলো। একটি মিথ্যা বা গুজবকে কাপুরুষের মতো ছদ্মনামে জনসম্মুখে তুলে ধরে পালিয়ে বেড়ালেই কি মানুষের সম্মান ক্ষুন্ন করা হলো। নিশ্চয়ই নয়। সম্মান ও নেতৃত্ব স্রষ্টার দান। নেতা বা সংগঠক কিংবা লেখক কবি হওয়ার চেষ্টা করা সহজ। কিন্তু সবার গ্রহণযোগ্য হয়ে সফল হওয়া কিন্তু কঠিন।

রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছেন ১৯১৩ সালে। তাঁর এই নোবেলপ্রাপ্তিতে সারা বাংলা এমনকি তৎকালীন ভারতের সর্বত্র ধন্য ধন্য করেছে এমন কিন্তু নয়। দু’একজন নিন্দার কাঁটাও ছুড়েছেন । একজন তো সরাসরি জানতেই চেয়েছেন, ‘পুরস্কার বাগাতে ঠাকুরের কত খরচ হলো?’

কবিকে প্রশ্নটি ওই ব্যক্তি করেছিলেন একটি চিঠির মাধ্যমে। আবিষ্কৃত হয়েছে সেই চিঠিও। মজার ব্যাপার হলো, রবিঠাকুরকে চিঠিটি যিনি লিখেছিলেন, তিনি নিজেও ছিলেন নোবেল পুরস্কারপ্রত্যাশী। তাই একটি লোভনীয় প্রস্তাবসহ কবিকে তিনি চিঠি পাঠালেন। লিখলেন, ‘সবিনয় নিবেদন, আপনার নোবেল প্রাইজ পাওয়ার টেকনিক অতি সত্ত্বর জানান। তাহা হইলে আমি যদি প্রাইজ পাই, মোট প্রাপ্য টাকার অর্ধাংশ আপনাকে দিব।’

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিই নজরুলকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। নজরুলের এই ব্যাপক জনপ্রিয়তায় অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়লো। মোহিতলাল মজুমদারের মত অনেক প্রথিতযশা সাহিত্যিক তাঁকে হেয় করতে লাগলেন। প্রচার করতে লাগল মিথ্যাচার। তিনি দাবী করলেন, নজরুল তাঁর “আমি” প্রবন্ধের ভাববস্তু চুরি করেই “বিদ্রোহী” কবিতাটি লিখেছেন। শুধু তাই নয়, মোহিতলাল ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি করে একটু কবিতা লিখলে “ব্যাঙ”।
‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার ১৩৩১ সালের ১৮ আশ্বিন সংখ্যায় ‘বিদ্রোহী’র ব্যাঙ্গরূপ ‘ব্যাঙ’ রচনা করেছিলেন সজনীকান্ত দাস ছদ্মনামে। ‘ব্যাঙ’ এর শুরুটা হয়েছিল ঠিক এভাবে-

আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাং,
ভৈরব রভসে বর্ষা আসিলে ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাঙ

আমি ব্যাঙ,
আমি পথ হতে পথে দিয়ে চলি লাফ;
শ্রাবণ-নিশার পরশে আমার সাহসিকা
অভিসারিকা
ডেকে ওঠে ‘বাপ বাপ’।

এতে করে বিদ্রোহী কবিতার আবেদন ও উজ্জ্বলতা একটুও কমে নাই।

সে সময়ের একটি সাহিত্য’ বিভাগে আক্রমণাত্মক সমালোচনার অংশ হিসেবে ‘জীবনানন্দ দাশ’ নামটিকেও আপত্তিকরভাবে তুলে ধরা হয়। ‘জীবানন্দ নহে’ বা ‘জিহ্বানন্দ নহে’ বলা হয়। এছাড়া ‘কবি গণ্ডার’ও বলা হয়।

‘শনিবারের চিঠি’ সাহিত্য পত্রিকায় জীবনানন্দ দাসকে নিয়ে বলা হলো,’এই প্রতিভাবান কবিদের আর একটি কৌশল- কবিতা লিখিতে লিখিতে অকস্মাৎ অকারণে এক-একজন ভদ্রলোকের মেয়ের নাম করিয়া আমাদিগকে উৎসুক ও উৎসাহিত করিয়া তোলেন।. …..ইহার সূত্রপাত হইয়াছে নাটোরের ‘বনলতা সেন’কে লইয়া।’
অথচ বনলতা সেন বাংলা সাহিত্যের অনন্য কবিতা।

জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে আরেকজন প্রথিতযশা বহুমাত্রিক লেখক বলেছিলেন, ‘ হুমায়ুন, অনেক তো লিখলে, এবার সাহিত্য রচনা কর”
এতে করে হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা একটুও কমেনি।

মনে রাখতে হবে, প্রসবের গুনে নয়, লেখার গভীরতায় কবি বা লেখক হয়ে উঠতে হয়। কবি হেলাল হাফিজের কাব্যগ্রন্থ মাত্র দুটি ‘যে জলে আগুন জ্বলে'(১৯৮৬), ও
বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা (২০১৯)।
এছাড়া ‘কবিতা ৭১’ (বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায়, একুশে বইমেলা ২০১২) ও ‘এক জীবনের জন্মজখম’ উল্লেখযোগ্য।

,

ঠিক এ ভাবে নয় আরও নোংরা ভাবে, আজকাল সাহিত্য নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের মানহানি করা হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে কাঁদা ছুঁড়াছুঁড়ি। এর অন্তরালে রয়েছে একশ্রেণির দুর্বলচিত্তের সংগঠক বা লেখালেখি করছেন এমন মানুষ। ইন্ধন যোগাচ্ছে প্রতিহিংসাপরায়ন কিছু অসুস্থ ভাবনার লেখক। মনে রাখবেন পুরস্কার কাজের স্বীকৃতি। পুরস্কার পাওয়ার পর তার কাছ থেকে কালজয়ী লেখা পাওয়া গেছে এমন লেখক আমাদের দেশে পাওয়া দুস্কর। বিশ্বের কোনো পুরস্কারই সমালোচনার উর্ধে নয়।
একেক জনের লেখার প্রকাশভঙ্গী একেকরকম। আমি দুর্বল বলেই আপনার লেখা আমার চেয়ে বেশি পাঠক পড়ে। আমি আপনার চেয়ে শক্তিশালী শৈল্পিক লেখা লিখতে পারলে আপনার লেখা কেউ পড়তই না।

ঢালাও ভাবে এক দুইজন মানুষের বেনামে বা ফেক আইডি থেকে বিরুদ্ধাচরণের নামে বিষেদাগার করছেন তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। মনে রাখবেন টিকে থাকতে হবে আপনার সৃষ্টিকর্ম দিয়ে, প্রতিযোগিতা থাকা ভালো প্রতি হিংসা ভালো নয়। সময়ের দৌড়ে হারিয়ে যাবেন।

মানুষের ক্ষতি করতে উপকার করার চাইতে বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয়। তাই আসুন আমার আপনার এই বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা সৃষ্টিশীল কাজে ব্যবহার করি। কাউকে ছোট করতে হলে তাকে কেটে ছোট করার দরকার নেই। নিজে বড় হলেই সে ছোট হবে। তাই আসুন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করি, নিজেকে বিকশিত করি। অন্যের পথ সুগম করি। আমার বিশ্বাস সৃষ্টিশীল মানুষ আত্মঘাতী হতে পারে না। আসুন পরচর্চা না করে আত্মসমালোচনা করি। বাড়িয়ে দেই বন্ধুত্বের হাত।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD