রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩৭ পূর্বাহ্ন

রেহানে জাব্বারির মর্মস্পর্শী চিঠি মাকে

রেহানে জাব্বারির মর্মস্পর্শী চিঠি মাকে

এ গল্প ইরানের ফাঁসিপ্রাপ্ত এক তরুণীর।পেশায় তিনি ছিলেন ইনটেরিয়র ডিজাইনার।সম্ভ্রম বাঁচাতে আত্মরক্ষার তাগিদে তিনি হত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন এক কামুক পুরুষকে।তাঁর অভিমান ছিল,দুনিয়ার কেউ কেউ তাঁকে ভালোবাসেনি । ফাঁসিতে মৃত্যুর আগে ২৬ বছরের মেয়েটা বলেছিলো ,তাঁর দেহ যেন মাটির তলায় পচানো না হয়।তাঁর অঙ্গদান করে দিতে হবে যাদের সেসব অঙ্গ দরকার।তাই করা হয়েছে।
রেহানে,কুমারী মাটির বুকে তুমি তো পেলে মরণোত্তর ভালোবাসা।আর তুমি দিয়ে গেলে ক’জন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে তোমার মানবিক ভালোবাসা।
তুমি ঘুমোও হে মহান মানবপ্রমী।আমরা জেগে আছি তোমার কথা সবাইকে জানানোর জন্য ।

ফাঁসির মঞ্চ হতে মাকে লেখা ইরানী মেয়ে রেহানে জাব্বারির মর্মস্পর্শী শেষ চিঠি-

স্টাফ রাইটার।।ধর্ষিতা হবার পর আঁততায়ীর (ধর্ষকের) বুকে ছুরি বসানোর অপরাধে প্রাণদণ্ড দেয় ইরানের সুপ্রিম কোর্ট।ফাঁসির মঞ্চ হতে মাকে লেখা সেই ইরানী মেয়ে রেহানে জাব্বারির শেষ চিঠি পাওয়া গেছে।

জানা যায়,গত কয়েক বছর আগে অক্টোবরের ২২ তারিখ ফাঁসি হয়ে গেছে রেহানে জাব্বারির।বয়স হয়েছিল মাত্র ২৬ বছর।ধর্ষিতা হবার পর ধর্ষকের বুকে ছুরি বসানোর অপরাধে তাকে প্রাণদণ্ড দেয় ইরানের সুপ্রিম কোর্ট।রেহানের ফাঁসির আদেশের বিরোধিতা করে আসছিল গোটা বিশ্বের অজস্র মানবাধিকার সংগঠন।প্রাণভিক্ষার অনুরোধ জানান বিশ্বের অনেক জননেতারা।মেয়ের বদলে তাকেই ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হোক বলে মিনতি করেছিলেন রেহানের মা শোলেহ। কিন্তু কোনো কিছুতেই কান দেয়নি সরকার।ভোরের আলো ফোটার আগেই নিভিয়ে দেওয়া হয় প্রাণবন্ত একটি জীবন প্রদীপ।

মৃত্যুর আগে রেহানে মাকে শেষ চিঠি লিখে গিয়েছেন।হৃদয় নিংড়ানো সেই চিঠিতে মাকে শোকগ্রস্ত হতে বারণ করেছেন তিনি।মৃত্যুকে তিনি অভিহিত করেছেন নিয়তির বিধান হিসেবেই।তবে রেহানে তিলমাত্র অনুতাপ করেননি তার মৃত্যুদণ্ডের জন্য,বরং ফাঁসির পর তার দেহাংশ দান করার অনুরোধ করেছেন জন্মদাত্রীর নিকট।রেহানের সেই মর্মস্পর্শী চিঠি গণমাধ্যমের হাতে তুলে দিয়েছেন মানবাধিকার সংগঠন এবং শান্তিকামী গোষ্ঠীর সদস্যরা।মাকে লেখা রেহানে জাব্বারির শেষ চিঠিটি নিন্মে হুবহু প্রকাশ করা হলো:

মাকে লেখা রেহানে জাবারির শেষ চিঠি

প্রিয় শোলেহ,

আজ জানতে পারলাম এবার আমার কিসাস (ইরানের আইনব্যবস্থায় কর্মফলবিষয়ক বিধি)-এর সম্মুখীন হওয়ার সময় হয়েছে।জীবনের শেষ পাতায় যে পৌঁছে গিয়েছি,তা তুমি নিজের মুখে আমায় জানাওনি ভেবে খারাপ লাগছে।তোমার কি মনে হয়নি যে এটা আমার আগেই জানা উচিত ছিল?তুমি দুঃখে ভেঙে পড়েছ জেনে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছি।ফাঁসির আদেশ শোনার পর তোমার আর বাবার হাতে চুমু খেতে দাওনি কেন আমায়?

দুনিয়া আমায় ১৯ বছর বাঁচতে দিয়েছে। সেই অভিশপ্ত রাতে আমারই তো মরে যাওয়া উচিত ছিল,তাই না?আমার মৃতদেহ ছুড়ে ফেলার কথা ছিল শহরের কোনো অজ্ঞাত কোণে।কয়েক দিন পর মর্গে যা শনাক্ত করার কথা ছিল তোমার।সঙ্গে এটাও জানতে পারতে যে হত্যার আগে আমাকে ধর্ষণও করা হয়েছিল।হত্যাকারীরা অবশ্যই ধরা পড়ত না,কারণ আমাদের না আছে অর্থ,না ক্ষমতা।তারপর বাকি জীবনটা সীমাহীন শোক ও অসহ্য লজ্জায় কাটিয়ে কয়েক বছর পর তোমারও মৃত্যু হতো।এটাই যে হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু সে রাতের আকস্মিক আঘাত সব কিছু ওলোটপালট করে দিল।শহরের কোনো গলি নয়, আমার শরীরটা প্রথমে ছুড়ে ফেলা হলো এভিন জেলের নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে,আর সেখান থেকে কবরের মতো এই শাহর-এ রায় কারাগারের সেলে।কিন্তু এ নিয়ে অনুযোগ করো না মা,এটাই নিয়তির বিধান।আর তুমি তো জানো যে মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যায় না।

মা,তুমিই তো শিখিয়েছ অভিজ্ঞতা লাভ ও শিক্ষা পাওয়ার জন্যই আমাদের জন্ম।তুমি বলেছিলে, প্রত্যেক জন্মে আমাদের কাঁধে এক বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া থাকে।মাঝে মাঝে লড়াই করতে হয়,সে শিক্ষা তো তোমার থেকেই পেয়েছি।সেই গল্পটা মনে পড়ছে,চাবুকের ঝাপ্টা সহ্য করতে করতে একবার প্রতিবাদ জানানোর ফলে আরও নির্মমতার শিকার হয়েছিল এক ব্যক্তি।শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হয়।কিন্তু প্রতিবাদ তো সে করেছিল! আমি শিখেছি,সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে অধ্যবসায় প্রয়োজন।তার জন্য যদি মৃত্যুও আসে, তাকেই মেনে নিতে হয়।

স্কুলে যাওয়ার সময় তুমি শিখিয়েছিলে,নালিশ ও ঝগড়াঝাটির মাঝেও যেন নিজের নারীসত্ত্বাকে বিসর্জন না দিই।তোমার মনে আছে মা,কত যত্ন করেই না মেয়েদের খুঁটিনাটি সহবত শিখিয়েছিলে আমাদের?কিন্তু তুমি ভুল জানতে মা।এই ঘটনার সময় আমার সে সব জ্ঞান একেবারেই কাজে লাগেনি।আদালতে আমাকে এক ঠাণ্ডা মাথার খুনি হিসেবে পেশ করা হয়।কিন্তু আমি চোখের পানি ফেলিনি।আমি প্রাণ ভিক্ষাও চাইনি।আমি কাঁদিনি কারণ আইনের প্রতি আমার অটুট আস্থা ছিল।

কিন্তু বিচারে বলা হলো,খুনের অভিযোগের মুখেও নাকি আমি নিরুত্তাপ।আচ্ছা মা,আমি তো কোনোদিন একটা মশাও মারিনি। আরশোলাদের চটিপেটা না করে শুঁড় ধরে জানলার বাইরে ফেলে দিয়েছি।সেই আমিই নাকি মাথা খাটিয়ে মানুষ খুন করেছি!উল্টো ছোটবেলার ওই কথাগুলো শুনে বিচারপতি বললেন, আমি নাকি মনে মনে পুরুষালি। তিনি একবার চেয়েও দেখলেন না, ঘটনার সময় আমার হাতের লম্বা নখের ওপর কী সুন্দর নেল পালিশের জেল্লা ছিল।হাতের তালু কত নরম তুলতুলে ছিল।সেই বিচারকের হাত থেকে সুবিচার পাওয়ার আশা অতি বড় আশাবাদীও করতে পারে কি?তাই তো নারীত্বের পুরস্কার হিসেবে মাথা মুড়িয়ে ১১ দিনের নির্জনবাসের হুকুম দেওয়া হলো।দেখেছ মা,তোমার ছোট্ট রেহানে এই কয়েক দিনেই কতটা বড় হয়ে গিয়েছে?

এবার আমার অন্তিম ইচ্ছেটা বলি শোনো।কেঁদো না মা,এখন শোকের সময় নয়।ওরা আমায় ফাঁসি দেওয়ার পর আমার চোখ,কিডনি,হৃদযন্ত্র,হাড় আর যা যা কিছু দরকার যেন অন্য কারও জীবন রক্ষা করতে কাজে লাগানো হয়। তবে যিনিই এসব পাবেন,কখনোই যেন আমার নাম না জানেন। আমি চাই না এর জন্য আমার সমাধিতে কেউ ফুলের তোড়া রেখে আসুক।এমনকি তুমিও নয়। আমি চাই না আমার কবরের সামনে বসে কালো পোশাক পরে কান্নায় ভেঙে পড়ো তুমি।বরং আমার দুঃখের দিনগুলো সব হাওয়ায় ভাসিয়ে দিও।

এই পৃথিবী আমাদের ভালোবাসেনি,মা।চায়নি আমি সুখী হই।এবার মৃত্যুর আলিঙ্গনে তার পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে।তবে সৃষ্টিকর্তার এজলাসে সুবিচার আমি পাবই।সেখানে দাঁড়িয়ে আমি অভিযোগের আঙুল তুলব সেই সমস্ত পুলিশ অফিসারের দিকে,বিচারকদের দিকে, আইনজীবীদের দিকে,আর তাদের দিকে যারা আমার অধিকার বুটের নিচে পিষে দিয়েছে, বিচারের নামে মিথ্যা ও অজ্ঞানতার কুয়াশায় সত্যকে আড়াল করেছে।একবারও বোঝার চেষ্টা করেনি,চোখের সামনে যা দেখা যায় সেটাই সর্বদা সত্যি নয়।

আমার নরম মনের শোলেহ,মনে রেখো সেই দুনিয়ায় তুমি আর আমি থাকব অভিযোগকারীর আসনে।আর ওরা দাঁড়াবে আসামির কাঠগড়ায়। দেখিই না,সৃষ্টিকর্তা কী চান!তবে একটাই নিবেদন, মৃত্যুর হাত ধরে দীর্ঘ যাত্রা শুরুর প্রাক মুহূর্ত পর্যন্ত তোমায় জড়িয়ে থাকতে চাই,মাগো!তোমায় যে খুব খু-উ-ব ভালোবাসি।

একটি প্রতিবেদনের অনুকরণে

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD