শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০১:০১ পূর্বাহ্ন

১৯৭৫ ও আমি – নির্মলেন্দু গুণ

নির্মলেন্দু গুণ

১৯৭৫ ও আমি
♦♦♦♦

নির্মলেন্দু গুণ

১৯৭৫ সালের ১১ নভেম্বর একজন কর্নেল পিজির সামনে থেকে আমাকে গ্রেফতার করেন। ১২ নভেম্বর হাতে হ্যান্ডকাপ এবং কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে আরও ক’জন আসামীর সঙ্গে প্রিজন ভ্যানে তুলে আমাকে পুরনো ঢাকায় মেজিস্ট্রেটের কোর্টে নেয়া হয়।

আমাকে এক সপ্তাহের রিমান্ডে রমনা থানাহাজতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। কখন আমাকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে কেন্টনমেন্টে নিয়ে যাবে– এই দুশ্চিন্তায় আমি পাঁচদিন পাঁচ রাত ঘুমাতে পারিনি। ১২০ ঘন্টা আমি রমনা হাজতের মেঝেতে শুয়ে-বসে কাটিয়েছি। তখন একটি কবিতা লিখেছিলাম–

“মাটির মানুষ পাথরে শুয়েছি,
ভাগ্য আমার ভাগ্য।
মাঝে মধ্যে বন্দীজীবন
এইভাবে হোক প্রাজ্ঞ।”

কী কারণে জানি না, আমি যখন মানসিকভাবে নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রায় প্রস্তুত করেই ফেলেছিলাম, তখন ১৬ নভেম্বর আমি মুক্তি লাভ করি। আমাকে সসম্মানে মুক্তি দেয়া হয়।

সেনাবাহিনী ও পুলিশের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আমি জেলখানায় নিহত চার জাতীয় নেতার আত্মত্যাগের কথা ভাবি। আমার সাহস বেড়ে যায়।
আসে ১৯৭৬ সাল। ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমিতে একুশের সকালে আমি “ভয় নেই” কবিতাটি পড়ি।

“ভয় নেই, আমি আছি
আগামীর যুদ্ধে,
ঘৃণার কৃপাণ হাতে
খুনির বিরুদ্ধে।”

১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমিতে একুশে ফেব্রুয়ারির কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে গ্রেফতার হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে আমি পড়ি “আমি আজ কারও রক্ত চাইতে আসিনি” কবিতাটি।


ঐ কবিতাটিই ছিলো কোনো প্রকাশ্য জনসমাবেশে শেখ মুজিবকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লেখা ও পাঠ করা প্রথম কবিতা।
ঐ কবিতা লেখা ও জনসমাবেশে পড়ার জন্য আমাকে বেশ কিছুদিন পুলিসের নির্যাতন ও নজরদারি সইতে হয়েছিলো। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে আমার সাহস ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার ভালোবাসার প্রমাণ, মনে হয় কিছুটা হলেও আমি দিতে পেরেছিলাম।

♦♦♦♦
এবার বাকশাল প্রসঙ্গে আমার অবস্থানের গল্পটা বলি। শামসুজ্জামান খান তাঁর বইতে আমার মুখ দিয়ে বাকশাল সম্পর্কে যেমনটি বলিয়েছেন– এটি আমি তাঁর জীবদ্দশায় পড়িনি। জানতাম না। আজই জানলাম।

 


আমি “রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫” নামে একটি বই লিখেছি। ঐ বইটি বাজারে রয়েছে। না থাকলেও আমার রচনাবলি, আমার আত্মজীবনী “মহাজীবনের কাব্য” এবং গদ্যসমগ্রর (১-৬) কোনো একটি খন্ডে পাবেন। আমি বাকশাল নিয়ে আমার ভাষ্য তুলে ধরলাম।

“কথাশিল্পী-সাংবাদিক জনাব রাহাত খান, বাংলা একাডেমির তৎকালীন পরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং সাহিত্যিক-রাজনীতিক মরহুম খন্দকার মুহম্মদ ইলিয়াস আমাকে বাকশালে যোগ দিতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমি বাকশালে যোগ দিইনি। আমার মনে হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করে একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং অসময়োচিত পদক্ষেপ নিয়েছেন। বাকশাল গঠনের ভিতর দিয়ে তিনি তাঁর ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে চাচ্ছেন– আমার মনে হয়েছিল, ঐরূপ অভিযোগ তুলে বিরোধী মহল এখন মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারবে।


বাকশাল গঠনের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমার নিজের মনেও কিছু সংশয় ছিলো। তা ছাড়া, কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে আমার মনের দিক থেকে সায় ছিলো না। আমি ভাবতাম, এখনো ভাবি, বড়ো রকমের জাগতিক দায়িত্ব পালনের জন্যই কবির কর্তব্য হলো, ছোটো ধরনের যাবতীয় দায়বদ্ধতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। কবির অবিনাশত্ব এবং সার্বভৌম-স্বয়ম্ভূতা সম্পর্কে আমি খুব তরুণ বয়স থেকেই ছিলাম অতিমাত্রায় সচেতন।

 

কবি শামসুর রাহমান এবং কবি মহাদেব সাহাও কাছাকাছি ধারণা পোষণ করতেন। তাঁরাও বাকশালে যোগদান করেননি। তবে ঐ দুজনের বাকশালে না-যোগদানের পটভূমি এক ছিলো না। মহাদেব সাহা বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ছিলেন। কিন্তু দৈনিক বাংলার পিকিংপন্থী রাজনৈতিক বৃত্তের ভিতরে বন্দী কবি শামসুর রাহমান, তখন পর্যন্ত ছিলেন মওলানা ভাসানীর ভক্ত।
অন্য প্রধান কবিদের মধ্যে কবি শহীদ কাদরী এবং আল মাহমুদ বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। শহীদ কাদরী তখন একটি মস্কোপন্থী ফিচার-সংস্থায় কাজ করতেন। তিনি বাকশালে বিশ্বাসও করতেন।
আমার সঙ্গে ১৯৯৩ সালে আমেরিকায় তাঁর দেখা হয়। ঐ বছর আমরা দু-জন একুশের একটি অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে শহীদ কাদরী বাকশালের পক্ষে কথা বলেছিলেন।


কিন্তু আল মাহমুদের বাকশালে যোগ দেবার সংবাদ শুনে সবাই খুব অবাক হয়েছিল। জাসদের সঙ্গে সকল আদর্শিক সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে, জেল থেকে মুচলেকা প্রদানের মাধ্যমে মুক্তিলাভ করার পরপরই বঙ্গবন্ধুকে গলায় ফুলের মালা পড়িয়ে আল মাহমুদ বাকশালে যোগ দেন।


দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত আবুল হাসানের সরকারী আনুকূল্য লাভের বিষয়টিকে আমরা মানবিক সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতাম। কিন্তু আল মাহমুদের বাকশালে যোগদানের সংবাদে আমরা খুবই কৌতুক বোধ করি।


ন্যূনতম অ্যাকাডেমিক শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই বঙ্গবন্ধু তাঁকে শিল্পকলা একাডেমিতে যে উপপরিচালকের চাকরিটি দিয়েছিলেন, বাকশালে যোগ না দেবার কারণে যদি ঐ চাকরিটি চলে যায়, ঐ রূপ কাল্পনিক ভয় থেকেই, মনে হয় আল মাহমুদ ঘটা করে বাকশালে যোগ দেন। তা ছাড়া তাঁর বাকশালে যোগদানের কোনো বিশ্বাসগত কারণ ছিলো না। তিনি বঙ্গবন্ধু বা বাকশাল কোনোটাতেই বিশ্বাস করতেন না।”

[ দ্র : মহাজীবনের কাব্য/ রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫/ পৃ- ৬৩১-৩২ ]
“রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫” গ্রন্থটির প্রকাশকাল – ১৯৯৭।
অলমিতি বিস্তারেন।

বাংলাদেশের প্রধান কবি ও প্রাবন্ধিক।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD