শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:২৯ অপরাহ্ন

ছোটো গল্প -আসল কথা – দোলা সেন

ছোটো গল্প -আসল কথা – দোলা সেন

ছোটো গল্প -আসল কথা - দোলা সেন

আসল কথা
||দোলা সেন||

সিঁড়ির রেলিংটা বেয়ে সুইই করে একতলায় নেমে এলো বিট্টু। এক লাফে রেলিং থেকে নেমে ঝট করে রান্নাঘরের সামনে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।

  • আসামী হাজিইইর। কৃষ্ণাপিসি বলল, তুমি নাকি আমায় ডাকছ?
    ডাস্টারে হাত মুছতে মুছতে কড়া চোখে তাকালো মীনাক্ষি।
  • এতো তাড়াতাড়ি এলি কি করে? নিশ্চয়ই আবার রেলিং বেয়ে….
    বিট্টু নিমেষে মুখটা বেজায় কাঁচুমাচু করে ফেলে – মানে ওই যে – মানে, কৃষ্ণাপিসি যে বলল..
  • কি বললো?
  • বললো যে – বাবু তুমি শিগিগিরি নিচে যাও। বৌদি তোমায় ডাকতিছে। খুব আগ করতিছিল কিন্তুক।
  • আর তাই তুমি সিঁড়ি না ভেঙে…. কতোদিন তোমায় বারণ করেছি বিট্টু? কোনদিন পড়ে হাত পা…
  • কোনো চিন্তা করো না মা। আমার ব্যালান্স খুব ভালো। এ তো বসে বসে স্লিপ কেটেছি। ইস্কুলে তো আমরা দাঁড়িয়েও…. অ্যালল্ –
    মা কালীর মতো ইয়াব্বড়ো জিভ বের করে মাঝপথেই থেমে যায় বিট্টু, আর রান্নাঘরে রাখা টুলটার ওপরে ধপ করে বসে পড়ে বিট্টুর মা। বিট্টুর মনে হয় ভাগ্যিস রান্নাঘরে টুলটা রাখা ছিল। কোমরের ব্যথার জন্য মায়ের মাটিতে বসা বারণ। আর মায়ের হাল দেখে মনে হচ্ছে টুলটা না থাকলে মাটিতেই বসে পড়ত।
    দূর বাবা! বিট্টু যত ভাবে এই কথাগুলো মাকে বলবে না, শেষরক্ষা করতে পারে না। কোনো না কোনোভাবে ঠিক বলে ফেলে। আর মাও খামোকা চিন্তা করতে থাকে। ডাক্তারকাকুও সেদিন বলেছিল – বৌদি চিন্তা কমান। এতো টেনশন করলে শরীর সারবে কি করে? বাবা থাকলে ব্যাপারটা ঠিক সামলে নিত। কিন্তু এখন বিট্টু যে কী করে!

পরিস্থিতি সামলে দিল দুধ। দুধ জ্বাল দিচ্ছিল মীনাক্ষি, আর তার মধ্যেই এতসব। তা সেই দুথ উথলে উঠে পড়ো পড়ো হতেই, মীনাক্ষি সব ভুলে তাই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আপাতত ফাঁড়া কাটলো দেখে বিট্টু খাওয়ার টেবিল থেকে একটা আপেল তুলে তাতে কামড় বসায়। জানে, মা এত সহজে ভুলবার পার্টি নয়। ঠিক ডাকবে এখুনি। তা সে যে ভুল জানে না, তার প্রমাণ দিতেই যেন মীনাক্ষি আবার হাঁক পাড়লো – বিইট্টুউউউ…
বিট্টু আপেল খেতে খেতেই দরজায় এসে দাঁড়াল।

  • কাল মাঠে কী হয়েছিল?
  • তেমন কিছু তো হয়নি মা –
    বলছে, আর দ্রুত মনে মনে ভেবে চলেছে – কাল বিকেলের ঘটনা আজ সকালের মধ্যেই মায়ের কান অবধি গড়ালো কী করে?
  • কিছু হয়নি? একেবারে কিচ্ছুটি নয় কেমন?
    মীনাক্ষির গলা ধাপে ধাপে চড়ছে।
  • সর্বজ্ঞবাবুর উঠোনে তোমরা গাদা গাদা নোংরা বল ফেলোনি?
  • সবগুলো নোংরা বল ছিল না। কয়েকটা নতুন বলও ছিল।
  • ওঃ! নতুনও ছিল? তা এই মহান কাজটি করা হলো কেন? ভদ্রলোক সক্কাল সক্কাল বাড়ি বয়ে এসে বলে গেলেন। আমি লজ্জায় মরি। তোর জন্য আমার লোকের কাছে মুখ দেখানো দায় হয়েছে। ছি ছি বিট্টু!
    মা তাকে ছি বললো! বিট্টুর মুখটা রাগে, দুঃখে, অভিমানে লাল হয়ে ওঠে।
  • আর ওই খিচকে বুড়োটা যে ওর পাঁচিলের বাইরের দিকে গাদা গাদা পেরেক পুঁতে রেখেছে তার বেলা? মাঠের দেওয়ালটাই তো ওর উঠোনের পাঁচিল। আমাদের যে কতো বল পাংচার হয়ে গেছে, তার খবর রাখো?
    আর ওই হাড়বজ্জাত বুড়োর উঠোনে বল পড়লে সেটা কোনোদিনও ফেরত দেয় না – তা জানো তুমি?
    তাই আমরা চাঁদা করে বিশুদার ঠেলা থেকে কিছু প্লাস্টিকের বল কিনেছি। আর তার সাথে পুরোনো বলগুলো সব, সঅব বল ওর উঠোনে ফেলেছি। ও কতো বল নিতে পারে আমরাও দেখবো। সবাই বন্ধুদের কাছ থেকে আরো পুরোনো ফাটা বল জোগাড় করব। আবার ওর উঠোন ভরে দেব।
    আবার নালিশ করতে আসা হয়েছে?
    বিট্টুর কথা এমনিতেই রাজধানী এক্সপ্রেস। তার উপর উত্তেজিত থাকলে ওকে কথার মাঝখানে থামানো শিবেরও অসাধ্য। অবশ্য মীনাক্ষি থামানোর অবস্থায় ছিলও না। যাকে বলে, হাঁ করে,বিস্ফারিত নয়নে, পুত্রের বচনামৃত পান করছিল। এবার আবার টুলে বসে পড়ে বলে – খিচকে বুড়ো? হাড়বজ্জাত? এসব ভাষা তুই কোথা থেকে শিখছিস বিট্টু? বড়দাদুর বয়েসী লোক, তাকে তুই…
    বিট্টু এখনো অনমনীয়। কালকে ওই বুড়ো তাদের উপর যে মধুর বাক্য প্রয়োগ করেছিল, তা সে মরে গেলেও মার সামনে উচ্চারণ করতে পারবে না। অতএব সে বুনো ঘোড়ার মতো ঘাড় বেঁকিয়ে বলে ওঠে – একদম বড়দাদুর নাম করবে না বলে দিচ্ছি।। কোথায় বড়দাদু, আর কোথায় ওই পাজি বুড়ো? তুমি আমায় মারতে চাইলে, যতখুশি মেরে নাও। কিন্তু ওই বদমাশ লোকটাকে আমি দাদু বলবো না – কিছুতেই না।
    মারবে বলেই হাত উঠিয়েছিল মীনাক্ষি, কিন্তু কেন জানি এর পরে হাতটা আপনিই নেমে গেল। ছেলের এই বিদ্রোহী মূর্তি তার একেবারে অপরিচিত বলেই হয়তো বা। শুধু সব পন্থা ফুরিয়ে গেলে, মায়েদের ব্যবহৃত চিরচারিত ব্রহ্মাস্ত্রটিই সে প্রয়োগ করল – আজ আসুক তোর বাবা।

তা বাবা আসুক না হয়। বিট্টুর তাতে ভয় নেই। বাবা কখনো একতরফা শুনে রায় দেয় না। “মার খেলে মার ফিরিয়ে দিবি” – এহেন অমোঘ বাণী তাকে বাবাই তো শিখিয়েছিল। দাদাটা কিন্তু একেবারে মায়ের মনের মতো হয়েছে। প্রতি বছর ক্লাসে সেকেন্ড বা থার্ড হয়। মারপিট করে না। বন্ধুদের কাছে কখনও মার খেলে, হয় সহ্য করে, নয়তো স্যারেদের কাছে নালিশ করে। আর সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, তার দাদা দশবছর ধরে স্কুলে পড়ছে, অথচ একবারও গার্জেন কল হয়নি! বিট্টু তাই মাঝে মাঝে ওর বাংলা বইয়ের একটা লাইন একটু পালটে নিয়ে বলে – হে উদয়, তোমার পানে চাহিয়া আমার বিস্ময়ের শেষ নাই।
উদয় অবশ্য রাগে না। বরং গম্ভীরভাবে বলে – সারাদিন দুষ্টুমি না করে একটু পড়লে তো পারিস?

  • পড়ি তো! ফেল করি নাকি? কিন্তু তোর মতো সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে ফার্স্ট হবার সাধনা করতে পারব না রে দাদা।
  • না পড়লে সবার চেয়ে পিছিয়ে যাবি যে?
    দু হাত জোড় করে বিট্টু বলে – তুই রকেটের স্পীডে এগোতে থাক দাদাভাই। আমি তোর জয়গান করেই খুশি। আমার দ্বারা হলো না রে। খেলা ছেড়ে শুধু বই মুখে করে বসে থাকতে পারবো না। স্রেফ মরে যাব।
    উদয় হাসে। আর কিছু বলে না। এই চঞ্চল ভাইটার প্রতি তার খুব মায়া। ওর মাথাটা ঘেঁটে দিয়ে বলে – চল রকেটের মতোই ওড়া যাক তাহলে!
  • মানে?
    উদয় ব্যাপারটা বিট্টুকে বুঝিয়ে বলে। সে একটা প্লেন বানাবার চেষ্টায় লেগে আছে। তার ধারণা, ঘরোয়া জিনিসপত্র দিয়ে সে একটা খেলনা প্লেন বানাতে পারবে। তাই সময় পেলেই, চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে নানা খেলনার অংশ, যন্ত্রপাতি নিয়ে খুটখাট করে। ইচ্ছে আছে স্কুলের প্রদর্শনীতে এটা বানিয়ে, সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে।
    বিট্টু উৎসাহিত হয়ে ওঠে।
  • সত্যি উড়বে রে দাদাভাই?
  • কয়েকটা জিনিস লাগবে আরও। কিন্তু কোথায় যে…
  • ও নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। আমাকে বল। আমি ঠিক জোগাড় করব।
  • আগে থেকে কাউকে বলিস না। না পারলে সবাই হাসাহাসি করবে।
  • বলবো না। গড প্রমিস।
    উদয় নিশ্চিন্ত হয়। বিট্টুর মতো করিতকর্মা ছেলে থাকলে তাকে জিনিসপত্রের কথা ভাবতে হবে না। তাই হলো। বিট্টু দাদার অর্ডারমতো নানান জিনিস সরবরাহ করতে থাকে। হাতে হাতে সাহায্য করে। অবশেষে একদিন সাধনার ফল ফলল। ঘরের মধ্যে প্লেনটা একটু উড়লোও। দুই ভাই খুব উত্তেজিত। এর পর তো সবকিছু ঠিক করে বাইরে ওড়ানোর অপেক্ষা।

কিছুদিন পর। বিট্টু আর উদয় মিলে বাগানে এসেছে। বিট্টু মহা উৎসাহে বাবা মাকেও ডেকে এনেছে। উদয়ের হাতে তার প্লেন। একটু জবরজং দেখতে বটে, কিন্তু উড়তে পারে দিব্বি। দুই ভাই মিলে ঘরে বারবার প্র্যাকটিস করে দেখেছে। এবার আকাশে ওড়ানোর পালা। জেটের মুখে আগুন দিলো উদয়। প্লেনটা ভোঁ করে আকাশে উঠেও গেল। কিন্তু একট চক্কর শেষ হবার আগেই, বোধকরি হাওয়াতে না কিসে কে জানে, টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে ভেঙে পড়লো! বাবা আর মা হো হো করে হেসে উঠলেন। আর উদয় বোকার মতো, এক হেরে যাওয়া মানুষের মতো মাথা নিচু করে টুকরোগুলো তুলে এককোণায় ফেলে দিতে দিতে বলল – কিচ্ছু হয়নি। কিচ্ছু পারলাম না। সরি মা, সরি বাবা।

মৈনাক হাসছিল। হাসছিল মীনাক্ষিও – যত্তো সব ছেলেমানুষি!
বিট্টু চুপ করেই ছিল। প্লেনটার এমন অধোগতি তার কাছেও অপ্রত্যাশিত। তবু সে জোরগলায় বলে উঠল – দাদাভাই, তুই সবচেয়ে দরকারি কথাটাই ভুলে যাচ্ছিস। বাবা, মা – তোমরাও বুঝতে পারছ না?

  • কি?
    কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো বিট্টু – প্লেনটা পড়ল কি করে?
  • আমি ফেল মেরেছি তাই! নীরস স্বরে জবাব দিল উদয়।
  • ভুল। পড়বার আগে প্লেনটা উড়েছিল রে ভোঁদাই! না হলে পড়লো কি করে? ওটা সত্যি সত্যি উড়েছিল – বুঝলি?
    হাসি থেমে যায়। উদয়ের মুখে আলো ফিরে আসে আবার। মৈনাক অবাক গলায় বলল – ঠিকই তো। এটা তো একদম খেয়াল হয়নি। সাব্বাশ উদয়। সাবাশ বিট্টু।
    মীনাক্ষি প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো – তুই কবে এতো বড়ো হয়ে গেলি বিট্টু? এই বোধ তুই কোথায় পেলি?
    বিট্টু মায়ের আদরে গলে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। মিটিমিটি হাসে – শুধু পড়লেই হয় না। খেলতেও হয়, বুঝলে? নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। সব নিখুঁত পাসেই কি আর গোল হয়? তাই বলে পাসটা তো আর ভুল হয়ে যায় না! যাক গে, আপাতত আমি খেলতে যাচ্ছি। আর তুই ভেবে দেখ দাদাভাই, কোন কোন জিনিসগুলো ঠিক করতে হবে।
    উদয় হঠাৎ স্বভাবিরুদ্ধভাবেই হো হো করে হেসে ওঠে।
  • একদম ঠিক বলেছিস বিটস। খেলতে হয়, নইলে…
    এক সেকেন্ড দাঁড়া ভাই। তোর সাথে আমিও মাঠে যাব।
    ||সমাপ্ত||
    দোলা সেন||

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD