কবিতায় আধুনিকতাবাদীদের নৈরাশ্যবাদ সম্পর্কে আবু সয়ীদ আইয়ুব উল্লেখ করেছেন, “দুঃখ ও পাপের মাত্রা আধুনিক কালে আগের চেয়ে বেড়েছে কি-না এ-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে; কিন্তু সাহিত্যের উপর তার ছায়া যে অতি বৃহৎ আকার ধারণ করেছে তাতে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই। প্রতিবিম্ব বিম্বকে আয়তনে এবং বর্ণের কালিমায় বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছে বলে আমার বিশ্বাস।”
বুদ্ধদেব বসু-কথিত ‘প্রথম দ্রষ্টা, কবিদের রাজা, সত্যদেবতা’ বোদলেয়ার সম্পর্কে আইয়ুবের একটি মন্তব্য, “বোদলেয়ারের বিরুদ্ধে আমার সবচেয়ে বড় নালিশ এই যে, তিনি প্রতিভাবান কবি অথচ তাঁর আশ্চর্য প্রতিভা তিনি ক্ষয় করেছেন তাঁর নিজের এবং আমাদের সকলের সর্বনাশ ঘটাতে। … সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ এই যে, বোদলেয়ারীয় ‘আঁনুই’-এর তন্নিষ্ঠ চর্চা আমাদের যুবকদের মনকে যৌবনের প্রারম্ভেই জরাগ্রস্ত করে দিচ্ছে।”
আঁনুই মানে নৈরাশ্যবাদ। নৈরাশ্য আর দুঃখবাদীতা আধুনিক সাহিত্যের গলায় এমন মাণিক্য হয়ে জড়ানো যে , দুটোকে আলাদা করা মুশকিল। কিন্তু শুভ ইচ্ছেকে অশুভ ইচ্ছে যদি পরাজিত করে আর বাকি সব প্রকাশ শুভ বোধের বিপরীতে সাহিত্যে বিরাজ করে, যার হাহাকারকে আমরা আধুনিকতার বিশিষ্টে রূপ দিচ্ছি, ের প্রতি এমন কঠোর কথাও আইয়ুব লিখেছেন:
‘সত্য-মিথ্যার ধার ধারে না কবিতা একথা যদি আধুনিকেরা বলতে চান বলুন, মানতে না-পারলেও শুনতে প্রস্তুত আছি। … কিন্তু যখন দেখি সত্যের ধার ধারেন না বলেই ছোটেন মিথ্যার কাছে বড় অঙ্কের ঋণে আদ্যোপান্ত নিজেকে জড়াতে, তখন প্রতিবাদ না করে পারি না। সমস্ত জগৎকে এবং মানুষ মাত্রকে শুভ ও সুন্দর বলে জানাটা যদি হয় স্বপ্নবিলাস, তবে সমস্ত জগৎকে এবং মানুষ মাত্রকে ঘৃণ্য ও বীভৎস বলে জানাটা দুঃখবিলাস।
পাখির গান, চাঁদের আলো, সুন্দরীর হাসি নিয়ে কাব্যে বাড়াবাড়ি করা যদি ন্যাকামি বলে নিন্দিত হয়, তবে মানুষের দুঃখ ও পাপ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা কঠোরতর ভাষায় ধিকৃত হওয়া উচিত, কারণ সে-বাড়াবাড়ির ফল হবে দারুণতর।দারুণতর হবে বিশেষত এই জন্য যে, অধুনাতন সাহিত্যিক অমঙ্গলবিলাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত দেখি মধ্যযুগের আদিপাপ সংক্রান্ত উন্মিলিতপ্রায় ডগ্মার বা তার বিকৃততর সংস্করণের পুনরুজ্জীবন।
আরো পড়ুনঃ মন বেঁধেছি মেঘের সাথে।শিল্পী মাহমুদা
মানুষের স্বভাবে এমন এক চিরজন্মগত দোষ অবশ্যই বিদ্যমান যাতে করে কোনো কালেই সে মানুষ হয়ে উঠবে না, আত্মরতিতে, পরশ্রীকাতরতায়, কপটতায়, হিংসায় নিমজ্জিত হয়ে থাকবে দূরতম ভবিষ্যতেও, এক পাপ ছাড়লে অন্য ঘৃণ্যতম পাপে লিপ্ত হবে-নবযুগের এই কুসংস্কারকে সুশিক্ষিত মানুষের মনে বদ্ধমূল করে তার কর্মপ্রেরণাকে অঙ্কুরে বিনাশ করে দেয়াটা আধুনিক সাহিত্যের এক দুরপনেয় কীর্তি’।
Leave a Reply