শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৩৩ অপরাহ্ন

নক্ষত্রের নিউক্লিয়াস ভেঙ্গে সাদা কফিন-মধ্যাহ্নের কোলাহল

নক্ষত্রের নিউক্লিয়াস ভেঙ্গে সাদা কফিন-মধ্যাহ্নের কোলাহল

নক্ষত্রের নিউক্লিয়াস

ড. মমতাজ বেগম বড়ভূইয়া

মধ্যাহ্নের কোলাহল
সম্পাদক: আনোয়ার শাহজাহান
প্রকাশকাল: ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ
প্রকাশনায়: আশা প্রকাশনী, সিলেট।

কবিতা মনের আকুতি। হৃদয়ের বিগলিত ভাষা। উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং চিত্রপটের মিশেল কবিতায় জীবনকে ফুটিয়ে তোলা যায়। একটি জাতির সত্তা, ব্যক্তির মানবিকতাবোধ কিংবা ঘৃণিতস্বরূপ প্রকাশ পায় কবিতার মাধ্যমে। এজন্য কবিতার সার্বজনীন আবেদন ব্যক্তি মাত্রই ধারণ করেন। এটা অনস্বীকার্য সত্য যে, প্রতিটি ব্যক্তিসত্তায় কবিতার আজন্ম স্রোত প্রবাহিত। সৃজনীশক্তির বৈচিত্র্যতা তা প্রকাশ করে, কিংবা নিভৃতে এর আবেদনময়ীতা গুমরে মরে। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদেও শ্লোকারে সেই আবেদন প্রতিভাত হয়েছে। হৃদয়ের পরিশীলতায় রাজাধিরাজদের কাছে তাই কবিদের ছিল ‘সভাকবি’র সম্মান। কবিতার কালক্রমের স্রোতধারায় সিলেটেও সেই জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এ অঞ্চলেও জন্ম হয়েছে বিদগ্ধ কবির। সুরমা পারের কবি দিলওয়ার থেকে বিশ্বাসের কবি আফজাল চৌধুরী বাংলাকাব্যে নির্মাণ করেছেন সুরম্য প্রাসাদ। এ প্রাসাদ ভেঙ্গে যাবার নয়। বাংলাসাহিত্যে কবিতার আবেদন যতদিন প্রবাহমান থাকবে, তাদের নির্মিত শৈল্পিক রচনাবলী বাংলাসাহিত্যে জৈবনিক প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টি করবে।

সাহিত্যে সম্পাদনা একটি অনন্য শিল্প। একটি নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণী প্রতিভা। কাব্যিক কিংবা সাহিত্যিক বিচারে এর মননশীলতায় সৃষ্টিশীলতার কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। অথবা সম্পাদনায় অনেক ক্ষেত্রে কবির বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন আলো ধরা পড়ে। প্রতিভাত হয় লেখকের চিন্তা-চেতনার স্বরূপ। সম্পাদনায় নিরীক্ষাধর্মী পর্যালোচনা এবং পর্যবেক্ষণী মনোভাবে ভিন্নচিন্তার লেখকের গুণগত মানকে সহজেই উপলব্ধি করা যায়। বাংলা সাহিত্যে এজন্যে সম্পাদনা একটা উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। সুতরাং, সম্পাদনার হাত ধরেই একটি নতুন ভাষা কিংবা ধারার জন্ম নিতে পারে। যদিও তা লেখকের স্বকীয় সত্তাকে মুছে ফেলে। তবুও সম্পাদনার মাধ্যমে প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক, সাংবাদিক ও সংগঠক আনোয়ার শাহজাহান’র তেমনি প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছে ‘মধ্যাহ্নের কোলাহল’ নামক কাব্যগ্রন্থে। এ কাব্যে ৫৮ জন কবির ৫৮টি কবিতা স্থান পেয়েছে। এ কবিতার নৈর্বক্তিক বিবেচনায় আনোয়ার শাহজাহানের ব্যক্তি নান্দনিকতার গভীর পাওয়া যায়।

‘সহসা চকিত হই, রক্তে সাজায় কারা বন্দুক?
তা’হলে আবার খণ্ড খণ্ড হবেই কামুক?’

কবি দিলওয়ার’র এই প্রতিবাদী চেতনায় একটি সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। অব্যক্তি গ্লানি, অবর্ণনীয় যন্ত্রণা এবং নারকীয় বিভীষিকার প্রেক্ষাপট থেকে তিনি জনতাকে কঠিন সংগ্রামের মুখে দাঁড় করাতে চান। এ কবিতায় তার জনমানুষের সাথে সম্পৃক্ততার পরিচয় উদ্ভাসিত করা হয়েছে।

ইংরেজ কবি কোলরিজের ভাষায় ‘পদ্য বা কবিতা মানে সর্বোৎকৃষ্ট শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো। আবার কবি এলিয়ট বলেন : ‘কবিতা রচনা হলো রক্তকে কালিতে রূপান্তর করার যন্ত্রণা।’ মধ্যাহ্নের কোলাহল কাব্যগ্রন্থে ব্যক্তিবোধের যন্ত্রণাকে কবিরা তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে আনোয়ার শাহজাহানের বিচারিক দক্ষতার প্রভাব গভীর লক্ষণীয়।

বিখ্যাত ইংরেজ কবি জন কীটস বলেন : ‘কবিতা মুগ্ধ করবে তার সূক্ষ্ম অপরিমেয়তায়, একটি মাত্র ঝংকারে নয়। পাঠকের মনে হবে এ যেন তারই সর্বোত্তম চিন্তা, যা ক্রমশ ভেসে উঠছে তার স্মৃতিতে।’ ‘মধ্যাহ্নের কোলাহল’ কাব্যগ্রন্থ পাঠে সেই অনুভূতিই বারবার হৃদয়ে অনুরণিত হয়েছে। বর্তমান সময়ের বিজ্ঞানকবি হাসনাইন সাজ্জাদীর ‘দুঃখের ধ্রুবতারা’ কবিতায় :

নক্ষত্রের নিউক্লিয়াস ভেঙ্গে সাদা কফিন
আস্তাকুঁড়ে গর্জে ওঠা দ্বন্দ্বের ধ্রুবতারা।’

সত্যিই কবিতায় বৈজ্ঞানিক ভাবপ্রকাশ এবং একে কেন্দ্রীভূত করে মনস্তাত্ত্বিক  দ্বন্দ্বের একটি করুণ আর্তনাদকে তিনি তুলে ধরেছেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক কবিতার দর্শন পাঠকমাত্রই হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

আনোয়ার শাহজাহানের অনন্য কৃতিত্ব তৎকালীন সিলেটের আলোচিত ৫৮জন কবির কবিতাকে ‘মধ্যাহ্নের কোলাহল’-এর কোলাহল পরিবেশে স্থান দিয়েছেন। এটা তার জীবনের একটি মাইলফলকও বটে। গণমানুষের কবি দিলওয়ার থেকে শুরু করে মোফাজ্জল করিম, মোহাম্মদ সাদিক, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, আকমল হোসেন নিপু, শামসাদ হুসাম,শহীদ সাগ্নিক, নৃপেন্দ্র লাল দাশ, হাসনাইন সাজ্জাদী, আহমেদ নূর, জফির সেতু, রাহমান লুৎফর, ফকির ইলিয়াছ, সারওয়ার চৌধুরী, সাদিয়া চৌধুরী পরাগ, মো: জিয়া উদ্দিন, ইখতিয়ার উদ্দিন, মুস্তাফিজ শফি, মমতাজ জাহান করিম, মাহবুব লীলেন প্রমুখ বিখ্যাত কবির কবিতাকে সংগ্রহ করে মধ্যাহ্নের কোলাহলকে আলোকোজ্জ্বল করে তুলেছেন।

মধ্যাহ্নের কোলাহল কাব্য সংকলনে কখনো কোনদিন’ শিরোনামে কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার গভীর এক মর্মবেদনা বুঝাতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, যারা মানুষ হয়েও মানুষের মতো অস্তিত্বপ্রান বস্তুদৃশ্য, ক্ষুদ্রখাদক, মকরের অনুরূপ অথচ মকর নয়। এমন কারো ছায়া যেন কবিকে কখনো কোনদিন স্পর্শ না করে।

আরো পড়ুনঃ হাসনাইন সাজ্জাদী’র কবিতা।।আড়ালে যেতে চাই এবার

কবি শামসাদ হুসাম এর ‘‘উচ্চারণ’’ শিরোনামের কবিতাটিতে ভেসে উঠে তীব্র প্রতিবাদের ভাষা। কবি এই সামাজিক সন্ত্রাসের বিবর্ণ প্রতিচ্ছায়ায় মধ্যযুগীয় দুঃশাসনে নীপিড়িত না হয়ে সত্ত্বার গভীরে অনন্ত বিস্তারে সীমাহীন ক্ষমতা নিয়ে প্রতিবাদের দেয়াল তুলে ধরতে চেয়েছে।

কবি হেলাল উদ্দীন রানা ‘‘মাটির মহিমা  অপরূপ’’ নামক কবিতাটিতে গ্রাম বাংলার অপরূপ চিত্র তুলে ধরেছেন। শত সংগ্রামে রক্তের বিনিময়ে মাথা উচিু করে ইতিহাসের পাতায় স্বাক্ষর রেখে যাওয়ার এক আকাঙ্খা তুলে ধরেছেন।

‘‘সময়ের গতিধারা’’ শিরোনামে কবি সুমা জায়গীরদার জীবনের সাথে সময়ের লুকোচুরি খেলার একটা হিসেব বুঝাতে চেয়েছেন। একটা সময় প্রতিবাদী, সংগ্রামী মানুষও পরবর্তীতে কিভাবে নিরব নিঃস্পৃহ হয়ে যেতে পারে তা তুলে ধরেছেন।

সিলেটের আলোকিত কবিদের কবিতা ও ব্যক্তিত্বের চিন্তা-চেতনার সাথে একাকার হয়ে আনোয়ার শাহজাহান নিজের একটি কবিতাকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যা তার বুদ্ধিমত্তা এবং বিচক্ষণতার পরিচায়ক। সত্যিকার অর্থে মহৎ ব্যক্তিদের সাথে নিজেকে জড়াতে কেই বা না চায়? অন্তত বেশিরভাগ ব্যক্তিই চান। আলোচিত দুনিয়ায় তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে দেখতে পাই, কোনো জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের দেখা পেলেই সেলফি তুলে আপলোড করে ফেলে যুবকেরা। কয়েকটি লাইক-কমেন্ট-বাহবা পাওয়ার জন্যে। একটু জানান দেওয়া-আমি ভিআইপি হতে চলেছি। আনোয়ার শাহজাহানও তার ব্যতিক্রম। কিন্তু তার জীবনের সাফল্য আছে। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে প্রকাশিত হওয়া ‘মধ্যাহ্নের কোলাহল’ তার মধ্যাহ্ন পেরিয়ে একটি অনাবিল স্বপ্নিল রাতের দিকে এগিয়ে চলেছি। এ সাফল্য হাজারো নির্ঘুম রাতের মধ্যে প্রশান্তির একটি ঘুমের ন্যায়। নিজের কর্মপ্রেরণা, দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা, ন্যায়নিষ্ঠতার মাধ্যমে আনোয়ার শাহজাহান নিজেকে সেই অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে নিয়ে গেছেন তিল তিল করে। তার ব্যক্তি জীবনের বহুমাত্রিক পরিধির বিচারে এটাই বলতে হয়- যাদের সাথে নিজের কবিতাকে জুড়ে দিয়েছেন, তাদের সাথেই তার উচ্চতার বিচার করা উচিত।

বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, আধুনিক বাংলাদেশের নারী প্রগতি আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব সুফিয়া কামালের অভিনন্দন বার্তা বইয়ের ব্যাক কাভারে প্রকাশ করেছেন সম্পাদক। এটি বইয়ের গুরুত্ব অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

‘মধ্যাহ্নের কোলাহল’ কাব্যগ্রন্থের সকল কবিতা গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে আনোয়ার শাহজাহানের একটি সার্থক পরিচয় পাওয়া যায়। যা তাকে আলাদা তথা স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল করে তুলেছে। দুনিয়ার পরাবাস্তব বিষয়গুলোকে তিনি কবির জবানে ফুটিয়ে তুলেছেন। এনেছেন দেশপ্রেমের প্রসঙ্গ, প্রকৃতি, মানবিকতা-মনুষ্যত্ব, সামাজিক হাহাকার-আর্তনাদ, বেদনার অমলিন দুঃখগাথা, স্বদেশচেতনা, আত্মোপলব্ধি, সংশয়দ্বন্ধ, জীবনবিধি তথা সার্বক্ষণিক দৃষ্টিকোণকে যেন তিনি সন্নিবেশিত করেছেন। এজন্য বলা যায়, এ কাব্যগ্রন্থে তিনি নিজেকে একজন সার্থক সম্পাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পরবর্তীতে তিনি মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা এবং সাংবাদিকতায় যে অবদান রেখেছেন তা জাতি কৃতজ্ঞতাচিত্তে স্মরণ রাখবে। আমি ব্যক্তি আনোয়ার শাহজাহানের সামাগ্রিক কল্যাণী জীবন কামনা করি। আশা করি তিনি মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ নিয়ে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা জাতিকে উপহার দিবেন। পাশাপাশি একজন কবি হিসেবে তার কাছে আবেদন তিনি যে কবিতার পথ মাড়িয়ে গবেষণায় নিজেকে উজাড় করতে পেরেছেন, সে কবিতা ও যেন তার হাত ধরে নতুন করে উজ্জীবন ফিরে পায়। আমি এ প্রত্যাশা করেই ব্যক্তি চেতনার দ্যোতক কবি আনোয়ার শাহজাহানের মননালোর আলোকপাত শেষ করছি।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক, সহযোগী অধ্যাপক, শ্রীকিষাণ সারদা কলেজ, হাইলাকান্দি, আসাম, ভারত।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD