সেই বার্ষিকী সেই সম্পাদকীয়
কতই তো বার্ষিকী প্রকাশিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে–কে তার খোঁজ রাখে! কিন্তু শিবিরশাসিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮২ সালে যে-বার্ষিকীটি প্রকাশিত হয়েছিল তাকে ঘিরে ঘটেছিল এমন দুটি অভিনব ঘটনা যার তুলনা বিরল।
মানুষ কবিতা মুখস্ত করে জানি, কিন্তু আস্ত একটি সম্পাদকীয় মুখস্ত করে ফেলেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্রছাত্রী। দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের ব্যবধানে নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ জকরিয়া আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই সম্পাদকীয়টি গড় গড় করে শুনিয়ে দিয়েছিলেন বছরদুয়েক আগে। তবে এক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন প্রয়াত ছাত্রনেতা ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর বক্তৃতায় আড্ডায় প্রায়শ উদ্ধৃত করতেন এই সম্পাদকীয়।
দ্বিতীয় বিস্ময়টি হলো তেলরংয়ের একটি চিত্রকর্ম। এখনো দেখা হলে শুভ্রকেশ অনেক প্রবীণও সাগ্রহে সেটির খোঁজ নেন। জানতে চান সেই মায়াবিনীর হদিস। বার্ষিকীটির প্রচ্ছদ ও বিষয়বস্তুর কথা কারো মনে নেই, বিস্ময়করভাবে তাদের হৃদয়ে কীভাবে যেন স্থায়ী আসন করে নিয়েছে একটি সম্পাদকীয় ও একটি ছবি। আসুন পাঠ করা যাক দীর্ঘ ৩৯ বছর আগের সেই সম্পাদকীয়।
সেই সম্পাদকীয়
“প্রতিশ্রুতির এক-শতাংশও পালন করতে পারিনি। এটা কোনো অক্ষম মানুষের ব্যর্থ সম্ভাষণ নয়; চক্রান্তের অক্টোপাশ বাহুতে আটকে যাওয়া বিপর্যস্ত মানুষের সরল স্বীকারোক্তি।
২
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আট হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মর্যাদার সাথে সম্পর্কিত ‘বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিকী’ সম্পাদনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিল আমার উপর। এর পেছনে ছিল ছাত্রসমাজের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা এবং তুলনাহীন বিশ্বাস। হয়তো এতোখানি ভারবহনের ক্ষমতা আমার ছিল না। তারপরও অর্পিত এই পবিত্র বিশ্বাসটুকু সংরক্ষণের জন্যে গত একটি বছর আমাকে লড়তে হয়েছে পারিপার্শ্বিক ও অভ্যন্তরীণ প্রচণ্ড প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে– আমার সমস্ত ক্ষমতা-অক্ষমতা নিয়ে। কারণ শুরু থেকেই সমগ্র পরিবেশটি ছিল আমার ভয়ানক প্রতিকূলে।
৩
এই বার্ষিকী যে-সংসদের প্রতিনিধিত্ব করছে, দুর্ভাগ্যজনক হলেও বার্ষিকী প্রকাশের ব্যাপারে সে-সংসদের অনুমতি পাওয়ার সৌভাগ্য শেষনাগাদ আমার হয়নি। এমনকি সংসদ কর্মকর্তারা ‘বার্ষিকী সম্পাদনা পরিষদ’-এর সর্বসম্মত সিদ্ধান্তকে পর্যন্ত উপেক্ষা করে। প্রভাবশালী কোনো কোনো মহলও এক্ষেত্রে সক্রিয় ইন্ধন জোগায়। অবশেষে গত ১৯শে জানুয়ারি মাননীয় উপাচার্যের বিশেষ অনুমতি এবং ‘বার্ষিকী সম্পাদনা পরিষদ’-এর সম্মানিত সদস্যবৃন্দের অপূর্ব সহযোগিতা বার্ষিকীর প্রকাশনা সুনিশ্চিত করে। এরপরও কাজ বন্ধ করার পাঁয়তারা চলে বিভিন্ন অজুহাতে। নগ্নভাবে চাপ সৃষ্টি করার যে প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল চাকসু-বুলেটিনকে কেন্দ্র করে তা অব্যাহত থাকে সংসদের সর্বশেষ দিন ১৯শে মার্চ ’৮২ পর্যন্ত। যে কারণে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে কাজ শেষ করা সত্ত্বেও বার্ষিকীর প্রকাশনা বিলম্বিত হয়।
৪
বার্ষিকী প্রকাশনার ব্যাপারে ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগিতা আশাতীত বলা চলে। লেখা জমা পড়েছে প্রচুর। অধিকাংশ রচনার মানগত দিকটি উপেক্ষা করার মতো ছিল না। তবুও বার্ষিকীর পরিসরের সংকীর্ণতা এবং ‘বার্ষিকী সম্পাদনা পরিষদ’-এর অত্যধিক সর্তকতার কারণে অনেক ভালো লেখাও ছাপানো সম্ভব হয়নি। বিশিষ্ট সাহিত্যিক আনিসুজ্জামানসহ উল্লেখযোগ্য অনেক শিক্ষক দেশের বাইরে অবস্থান করায় আমরা কিছু মূল্যবান রচনা থেকে বঞ্চিত হয়েছি।
৫.
সর্বাঙ্গীন সুন্দর ও নির্ভুল একটি বার্ষিকী উপহার দেয়ার সম্ভাব্য সবরকম চেষ্টাই আমি করেছি। অথচ বার্ষিকীর সর্বশেষ ফর্মাটি ছাপা হওয়ার পর মনে হচ্ছে, আমি যে-রকমটি চেয়েছি, ঠিক তেমনটি হয়নি। এই না-পারার এবং না-হওয়ার সূতীব্র অক্ষমতা, সীমাহীন অতৃপ্তিটুকু শুধুই আমার। তবুও, হাজারো প্রতিবন্ধকতার জাল ছিন্ন করে বার্ষিকী যে বেরিয়েছে–সেটাই এ-মুহূর্তের সবচে’ বড়ো সান্ত্বনা; নিজের কাছেই।
৬.
শুভেচ্ছা এবং সম্ভাবনার সকল দিগন্ত উন্মোচন হোক সবার জন্য। গাঢ় বিশ্বাস থেকে উত্থিত হোক মানুষের জয়গান। যে মানুষ ‘অবসাদে নুয়ে পড়ে তবুও ভাঙে না’। আর তাই ‘সাময়িক রুদ্ধ হয়–তবুও তো থামে না উত্থান’।”
মিনার মনসুর
Leave a Reply