আমার মেয়ে যে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে সেখানে অনেক (২৫ ভাগ) ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট রয়েছে। কলকাতার হিন্দু ধর্মালম্বী সৃজা ওর সুইট মেট। সৃজা খুবি মিষ্টিভাষী, হাসিখুশি একটা মেয়ে। আমার মেয়ের মুভিং ডে তে ওর সঙ্গে পরিচয়, গল্প হয়। ওর বেশ আত্মীয়, স্বজন রয়েছে বাংলাদেশে। নিজে না গেলেও ওর বাবা বাংলাদেশে গিয়েছিল। সৃজার সঙ্গে আমার মেয়ের বেশ সখ্য গড়ে উঠে। ভাষা, পোষাক, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতিতে মিল থাকলে সহজেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। ওদের একসঙ্গে ক্লাসও রয়েছে, সময় পেলে একসঙ্গে ব্রুকলিন ব্রিজে হাঁটতে বের হয়। ওদের বন্ধুত্বের কথা জেনে আমার ভালো লাগে। ‘ শুভ সকাল আম্মু! ভালোবাসি তোমাকে!’ আমার মেয়ে প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙে ক্লাসে যাওয়ার আগে আমাকে এই টেক্সট করে যায়। আমিও চোখ মেলে প্রতিদিন আধোঘুমে মেয়ের টেক্সট পড়ে স্বর্গীয় সুখ মনে মেখে দিনের শুরু করি! গতকাল সকালে চোখ মেলে ফোন হাতে নিয়ে দেখি, মেয়ে ইন্সটাগ্রাম হতে একটা ছবি পাঠিয়ে জানতে চেয়েছে, এসব কেন হচ্ছে, আম্মু? ছবিতে গত কয়েকদিন ধরে সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবকে ঘিরে বাংলাদেশের নানা স্থানে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, মন্ডপ ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার যে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটলো, এর চিত্র রয়েছে। দিনের শুরুতেই মেয়েটার মন খারাপের চিত্র দেখে আমার মন আরও বিষন্ন হয়ে উঠে। ওর ক্লাসের সময়সূচি জানা থাকলেও ঘড়ির দিকে না তাকিয়ে ওকে ফোন করি। ক্লাসে থাকায় ফোন ধরতে পারে নি। ক্লাস শেষে ফোন করে একই প্রশ্ন – এসব কেন হচ্ছে, আম্মু? সৃজার মন খারাপ। সৃজার কথা বলতেই আমার মনে পড়ে যায় আয়লান কুর্দির কথা। সিরীয় শরণার্থী শিশু আয়লান কুর্দির করুণ মৃত্যুতে চোখে পানি আসেনি এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। ২০১৫ সালের সেই ঘটনায় সাগরপাড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ছোট্ট আয়লানের মরদেহটি দেখে হৃদয় কেঁদেছিল সবার। শুধু সৃজা নয় যে কোন মানুষের মন খারাপ হবে বাংলাদেশে স্বজাতির উপর যা ঘটছে তা জেনে, দেখে। আমাকে চুপ থাকতে দেখে ফোনের অপরপ্রান্ত হতে মেয়ে বলল – ‘আম্মু আমরাও তো এদেশে সংখ্যালঘু! গত সপ্তাহে আমি ইউনিভার্সিটির যে ক্লাবে যোগ দিয়েছি সেখানে সব সাদা রঙের মানুষ। ওদের রঙ এবং উচ্চতা দেখে আমি জড়োসড়ো হয়ে ছিলাম। ওদের আন্তরিকতায় পরে স্বাভাবিক হয়েছি। একবার ভাবতে পারো, ওরা যদি আমার উপর শক্তি খাটাত, আমি কী টিকতে পারতাম!’ ওর কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি! মনে মনে বলি, তাইতো!
মেয়ের ফোন রেখে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। ফেলে আসা খাঁটি সোনায় মোড়ানো সময়ের কত কথা মনে পড়ে! আমার বাড়ীর কাছেই ছিল বিশাল হিন্দু বাড়ী। পূজা এলে আমার ছোটবেলার নির্মল প্রাণের বন্ধুরা মিলে আনন্দমুখরতায় ভরিয়ে তুলতাম আমার প্রিয় মমতা ঘেরা গ্রাম খানিকে! একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো ঈদের সময়ও। শুধু আনন্দ, উৎসব নয় যে কোন দুঃখ, কষ্টও আমরা সকলে মিলেমিশে ভাগাভাগি করে নিতাম! ঈদের দিন মুসলমান, হিন্দু একসঙ্গে যেমন পোলাও, জর্দা, সেমাই খেতাম, তেমনি পূজার সময় ঝকঝকে কাঁসার বাসনে নারিকেলের চিড়া, নাড়ু, ফুল্কো লুচি, নিরামিষ খেতাম। মনে হয় এখনো জিভে লেগে আছে সে স্বাদ! শবে বরাতের সময় আমাদের বাড়ীর হালুয়া, রুটি খেত যেমন, তেমনি ঈদের কোলাকুলিও করতাম আমরা একসঙ্গে। হিন্দু বাড়ীর ঠিক সামনেই ছিল মসজিদ। সন্ধ্যাবেলায় একদিকে আজানের ধ্বনি, অন্যদিক হতে উলুধ্বনি ভেসে আসত কানে। আমরা বন্ধুরা তখন মিলেমিশে গোল্লাছুট খেলায় ব্যস্ত। আজান, উলুধ্বনি শুনে বন্ধুরা যে যার উপাসনালয়ের পথে পা বাড়াত হাত ধরে। অন্ধকার গাঢ় হওয়ার আগে বিদায়ের নেয়ার সময় একে অন্যকে বুকে জড়িয়ে বলত- আগামীকাল বিকেলে আবার দেখা হবে। মসজিদের ইমাম কিংবা কোন মুসুল্লি কোনদিন তো বলেনি, তুই হিন্দু বা তুই মুসলিম? কি করছিস একসঙ্গে মসজিদ কিংবা মন্দিরের সামনে? ছোট্ট সময়ের সেসব দিনগুলোতে সবকিছুতে আমাদের মুগ্ধতা ছিল, হিংসা ছিল না! কে মুসলমান? কে হিন্দু? এসব কোনদিন মাথায় আসে নি। বড়রা কেউ এসব শেখায়ও নি। আমরা মানুষ ছিলাম, মানুষ হিসেবেই বেড়ে উঠেছিলাম!
ফকির লালন সাঁই’র
‘যেদিন হিন্দু, মুসলমান
হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান
জাতি-গোত্র নাহি রবে
এমন মানব সমাজ কবে গো, কবে গো সৃজন হবে?’
তেমনি কাজী নজরুল ইসলামের,
‘ হিন্দু না ওরা মুসলমান? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
হে কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র! ‘
মানবতার বাণী সম্বলিত এগুলো একসঙ্গে শুনতাম। কেউ কাউকে আঘাত করতাম না, সম্মান করতাম।
আমার/আমাদের কৈশোরে উৎসবের দিনগুলোকে রঙিন করে তুলত চিতই দাদা। জামার গলা, হাতার ডিজাইন কেমন হবে, কোথায় লেইস লাগাতে হবে, দুনিয়ার আব্দার করতাম তাঁর কাছে। ঈদের আগের দিন গোটা রাত জেগে সকলের আব্দার পূর্ণ করে ঈদের দিন সকালে ঝিমাতে ঝিমাতে বাড়ী ফেরার পথে তাঁর পথ আগলে ধরতাম, ঈদের সালামির জন্য। হাসিমুখে হাতে সালামি গুঁজে দিলে পরে পথ ছাড়তাম। এত জ্বালাতাম তবুও কোনদিন একটুও বিরক্ত হতেন না। বড় হয়ে আজ ভাবছি, কতটা সহানুভূতিশীল এবং বড় হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন তাঁরা। সঞ্জু স্যারের কাছে শিখেছিলাম বর্ণমালা। স্যারের ব্যক্তিত্ব, অন্তরের সৌন্দর্য আজও আমাকে মুগ্ধ করে। স্যারের কাছে শিখেছিলাম, মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে অন্তরের সৌন্দর্য বড়! স্যারের কাছে বিউটিফুল (Beautiful) শব্দটি শেখার পর উনি বলেছিলেন – সুন্দর যখন ছড়িয়ে পড়ে অসুন্দর তখন ঝিমিয়ে পড়ে! কথাগুলো মাথার ভেতর এত বছর পরও অহর্নিশি বাজতে থাকে!
ভাবছি, এগুলো কী খুব আগের কথা? কত বছর আগের কথা? কবে হতে আমরা মনুষ্যত্ব হারিয়ে এমন অকৃতজ্ঞ হয়ে উঠলাম? কীভাবে আমরা এমন উগ্র হয়ে উঠলাম? কখন থেকে আমাদের বোধের এমন বিকৃতি হলো? গত প্রায় দুই যুগ ধরে দেশের বাইরে রয়েছি। আমার আজকের বাংলাদেশকে বড় অচেনা লাগছে! আমার দেখা বাংলাদেশকে আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে মেলাতে পারছিনা! শুধু দেশ নয় নিজেকেও অচেনা লাগছে! কারণ, আমি, আমরা, আমাদের সন্তানকে একজন মানুষ হিসেবে বড় করতে পারি নি। এ লজ্জা আমার, আমাদের সকলের। যে সৃষ্টিকর্তা গোটা পৃথিবী তথা সকলকে অতি যত্নের সঙ্গে সৃষ্টি করেছেন, এবং দেখেশুনে রাখছেন, সেখানে আমি, আমরা কে, অন্যের বিশ্বাসের উপর নিয়ন্ত্রণ করতে যাব? মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলে একই সৃষ্টিকর্তার তৈরি! সৃষ্টিকর্তা বলেছেন – তাঁর সকল সৃষ্টিকে ভালোবাসতে! আমি বিশ্বাস করি ভালো কাজের জন্য সৃষ্টিকর্তা সকলকে যেমন পুরস্কৃত করবেন, তেমনি মন্দ কাজের জন্য সকলকে শাস্তি দেবেন। সৃষ্টিকর্তা কারো একার না, তিনি মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলের! দেশ কাঁদছে, মানুষ কাঁদছে। বর্বর, দূর্বৃত্ত, পিচাশ ছাড়া কোন মানুষ কখনো এমন অমানবিক হিংস্র কাজ করতে পারে না। এসব বর্বর, ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে সকলকে একসঙ্গে। যেমন করে ১৯৭১ সালে সকল ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল। এ সহিংসতা বন্ধ হোক। প্রতিটি মানুষ জেগে উঠুক! নয়ত এ ধর্মীয় বিভেদ মানবজাতিকে অচিরেই ধ্বংস করে দিবে! জাত, ধর্মের উপরে উঠে সকলে মানুষ পরিচয়ে শান্তিতে বেঁচে থাকুক, এমন সুন্দর পৃথিবীর জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি।
Leave a Reply