বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:০৮ অপরাহ্ন

বাঙালির সম্প্রীতি, বাঙালির সংস্কৃতি।।একটি পর্যালোচনা

বাঙালির সম্প্রীতি, বাঙালির সংস্কৃতি।।একটি পর্যালোচনা

বাঙালির সম্প্রীতি, বাঙালির সংস্কৃতি
একটি পর্যালোচনা
হাসনাইন সাজ্জাদী

বাংলাদেশকে ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে আধুনিক রাষ্ট্র মনে করতেন মনীষী আহমদ ছফা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূলে অবহেলিত একটি অঞ্চলে ভাষা ভিত্তিক একটি জাতিগোষ্ঠীর জন্ম শুধুমাত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভ্রম সংশোধনই নয় বরং তার বিপরী’ত একটি আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির বিজ্ঞানমনস্ক দেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল সর্বাগ্রে। এর ভীত কাজী নজরুল ইসলাম, ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও আবুল হোসেনরা করে দিয়ে গেছেন।

হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দকে কমিয়ে আনতে ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হিন্দু সাহিত্য ও মুসলিম সাহিত্যের চরম ধারাকে উপেক্ষা না করে এক সূত্রে বেধে দিতে চেয়েছেন। অতিভাক্ত ব্র্রিটিশ ভারতে যে মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯২৬ খ্রিষ্ঠাব্দে । ছিল তাদের লক্ষ্য মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা । কিš‘ একসময় তা বাঙালি মানস তৈরীতে প্রধান ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বার্ষিক অধিবেশন (মার্চ ১৯২৯) এ অভ্যার্থনা কমিটির সভাপতি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যে অভিভাষন দিয়েছিলেন তাতেই বাঙালি সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির ভিত রচিত হয়েছিলো। তিনি বলেছেন; ‘বাংলা সাহিত্য বাংলার হিন্দু মুসলমানের অক্ষয় মিলন মন্দির হবে। হিন্দু সাহিত্য ও মুসলিম সাহিত্য তার দুই কুঠরী। সর্বত্রই সকলের অবাধ প্রবেশ অধিকার।’

এরমধ্য হিন্দু মুসলিম লেখকদের মধ্যে তিনি মিলন রেখা তৈরী করতে সচেষ্ট হন। ১৯৫৪ খ্রিষ্ঠাব্দে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষনে তিনি বলেন; ‘স্বাধীনতার নতুন নেশা আমাদের মতি”ছন্ন করে দিয়েছে। আরবী হরফে বাংলা লেখা, বাংলা ভাষায় অপ্রচলিত আরবী-ফারসি শব্দের অবাদ আমদানী, প্রচলিত বাংলা ভাষাকে গঙ্গা তীরের ভাষা বলে তার পরিবর্তে পদ্মাতীরের ভাষা প্রচলনের খেয়াল-প্রভৃতি বাতুলতা একদল সাহিত্যিককে পেয়ে বসলো ।

… ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা, রবীন্দ্রনাথ, শরৎ এবং অন্যান্য পশ্চিমবঙ্গের কবিও সাহিত্যিকজনের কাব্যও গ্রš’ আলোচনা এমনকি বাঙালী নামটি পর্যন্ত যেন
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে কেউ কেউ মনে করতে লাগলেন। এ রকম পরি¯ি’তিতে যারা বাঙালি সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির কথা-বলাবলিও লেখালেখিতে অব্যাহত রাখতে চাইলেন তাদের ওপর নেমে আসলো খড়গ। কবি গোলাম মোস্তফার আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে কবি আবুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরি ইস্তফা দেয়ার পরও তাকে হত্যার জন্য পিস্তল হাতে ঘাতক বাসা পর্যন্ত তাড়া করেছিল।

কেউ কেউ ক্ষমাপত্র লিখে শেষ রক্ষা করেছিলেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রগতি ও সম্প্রীতি চিন্তার ছিল পথ প্রদর্শক । তবে ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করেই তারা ছিলেন ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতির সমর্থক। এটাই আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির গোড়ার কথা।

কিন্তু মুক্তবুদ্ধির চর্চার অভিযাত্রায় যারা অচল ছিলেন তাদেরকে যখন অতিষ্ঠ করা হয়েছিল তখনই কবি সৈয়দ শামসুল হক লেখেন তার একুশের কবিতায়; “…এসো কবিতম যোদ্ধা, এসো বজ্র, এসো, / এসো বিষ, এসো প্রীতি, সেরে তোল ক্ষত/ মানুষকে কবি করো এসো, এসো, এসো;/ কবিকে মানুষ করো, এসো, এসো, এসো,” তখন এটা পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, একদল কবিও সাংস্কৃতিক যোদ্ধারা কিভাবে, কত ভাবে যে সাম্প্রদায়িক বিষ বাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে।

কবি আল মাহমুদের সোনালী কাবিনে পত্র¯’ তার কবিতা থেকে আমরা তাকেও তখন সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরোধীতা করতে দেখি। যদি তিনি পরবর্তীকালে তার অবস থাকতে পারেননি।

তিনি লেখেন; “আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বন্টন/ পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উ”েছদ,/ এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উ”চারণ,/ যেন না ডুকতে পারে লোক ধর্মে আর ভেদাভেদ।” আল মাহমুদের সেই আহ্বান আমাদের আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও তিনি নিজে এক সময় বাঙালির সম্প্রীতির দেয়ালে ফাটল ধরাতে শেষ পেরেক টুকে দেন। সৈয়দ আলী আহসান, ফররুখ আহমেদ, গোলাম মোস্তফা, আল মাহমুদকে বাদ দিয়েই বাঙালি কবি সাহিত্যিকেরা সম্প্রীতির দৃঢ়তায় আজ বাঙালি সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা দিতে সক্ষম হয়েছেন।

আল-মাহমুদের কদর রাত্রির প্রার্থনা ভাষায় আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি এবং বাঙালির ধর্মী নিরপেক্ষ সাহিত্যকে হত্যা করে বসে । তবুও এক সময় আহমদ ছফার কথাই সঠিক বলে মনে করা হত। বাঙালি সংস্কৃতি থেকে প্রাণরস আহরণ করে জাতীয়তার বোধটি পুষ্ঠ এবং বিকশিত হয়েছে। তথাধিক বাংলাদেশের সংস্কৃতির আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। কবিতায় জটিল সংকট সংস্কৃতি চর্চার পথটিকে কন্টকাকীর্ণ করে রেখেছে।

বাংলাদেশের সংখ্যাধিক জনবলের মানস সংকটেরই প্রতিফলন ঘটছে সংস্কৃতিতে (বুদ্ধিভিত্তিক নতুন বিন্যাস, পৃষ্ঠা- ২৫-২৬)।’ কিš‘ সে অব¯’া বেশীদিন টিকে থাকেনি। বর্তমানে নজরুল-রবীন্দ্র চর্চা, বোশেখ শুভযাত্রা, নবান্ন উৎসব, বসন্ত উৎসব, একুশে উদযাপন, বড়দিন পালন, ঈদ উৎসব, দূর্গাপূজা প্রভৃতি সম্মালিত ভাবে উদযাপন আয়োজন ধর্ম যারযার উৎসব সবার মনোভাব বাঙালি সংস্কৃতিকে সকল বাধা মুক্ত করে এগিয়ে চলেছে। আহমদ ছফা এর মূলটা ধরে টান দিয়ে এভাবে বলেছেন; বাংলাদেশী রাজনীতি সংস্কৃতি যা কিছু উজ্জ্বল অংশ তার সিংহ ভাগই বামপš’ী রাজনীতির অবদান। (পূবোর্ক্ত, পৃষ্ঠা-৩৭)।”

তারপরেই তিনি বলেছেন; “ ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বামপš’ী রাজনীতির উত্তাপ থেকেই বাঙালী সংস্কৃতির নবজন্ম ঘটেছে।” অধ্যাপক মোজাফর আহমদের লেখা ও ১৯৫৪ খ্রিষ্ঠাব্দে প্রকাশিত ‘ হোয়াট ইজ অটনাম’ গ্রšে’ পূর্ব বাংলার জাতিসত্তার প্রশ্নটি বেশ জোরালো ভাবে আলোচিত হয়েছে যা বাঙালির সংস্কৃতি বিকাশের পথে ছিল এক বড় অবলম্বন।


লেনিল বলেছেন; “ সাহিত্যও সংস্কৃতি চর্চাকে যারা শ্রেণী নিরপেক্ষ বলে কলাকৈবল্য বাদ প্রচার করে তারা নির্মম ভ- ব্যাতিত আর কিছু নয়। তাই যারা এ ক্ষেত্রে কলাকৈবল্য বাদের কথা বলে তারা আসলে শোষক শ্রেণীর সাহিত্য সংস্কৃতি, তাদের কাব্য চর্চা ইত্যাদির সঠিক শ্রেণী চরিত্রকে শোষিত শ্রেণীর চোখের আড়াল করার উদ্দেশ্যেই তা বলে থাকে।


নজরুল ভারতীয় সনাতন মিথ ব্যাবহার করেছেন তার সম্প্রীতি চিন্তায়। তিনি লিখেছেন: ‘ বলতে পারিস বিশ্ব-পিতা ভগবানের কোন সে জাত?
কোন ছেলের তার লাগলে ছোঁওয়া অসূচি হন জগন্নাত?


নারায়নের জাত যদি নাই,
তোদের কেন জাতের বালাই?
(তোরা) ছেলের মুখে থুথু দিয়ে মা’র মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া”। জাতের বজ্জাতি (বিষের বাঁশী)। হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য নজরুল প্রচুর লিখেছেন। এমনটি তিনি নিজেও ব্যক্তি জীবনে সম্প্রীতি চিন্তাকে জিরোটলারেন্সে-নিয়ে এসেছেন, আমরা তার সে জীবনবোধের কথা জানি। আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি চিন্তার এক জলন্ত পুরুষ তিনি। তার সম্প্রীতির কবিতাগুলো ধর্মে ধর্মে জাতিতে জাতিদ্বেষও হিংসার বিরুদ্ধে আজ বিশ্বে- প্রশংসিত হয়েছে৷

গবেষকরা তার সম্প্রীতি চিন্তার কবিতাগুলোকে কালজয়ী হবার বিষয়টি এখন নানা ফোরামে তুলে ধরছেন। প্রমিলার সাথে সংসারের কথা জানি। আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতিষ্ঠান ইউ আর আই এখন তাকে সম্প্রীতির দূত হিসাবে বিবেচিত করে থাকে। হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে পূজারী-মুনষী, মোল্লা- মৌলভীদের তিনি ধর্মীয় হানাহানির জন্য দায়ী বলে মনে করতেন।

বিশ্ব এখন যত এগিয়ে চলেছে আমরা নজরুল মানসের বাঙালিরা সম্প্রীতি চিন্তার জন্য তত বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষন করছি।
এই সম্প্রীতি থেকেই আজ‘ উৎসব সবার -ধর্ম যার যার’ স্লোগান বাংলাদেশে জনপ্রিয়।

আমরা একে অন্যের উৎসবে ধর্মমত নিবিশেষে অংশ নি”িছ। জীবনের বোধকে আজ আমরা সম্প্রীতি চিন্তায় জয় করে চলেছি। এমন সাম্য সুখের সম্প্রীতির সমাজ প্রতিষ্ঠায় নবান্নের উৎসব, বসন্ত উৎসব, বোশেখের শুভমিছিল, বাংলা নববর্ষ, ইংরেজী নববর্ষ, একুশে উৎসব, স্বাধীনতা দিবস প্রভৃতিকে আমরা এখন সর্বজনীন করে নিয়েছি। তাই বৈশাখী, দূর্গাপূজা, ঈদ, বড়দিন প্রভৃতিও এক অর্থে সর্বজনীন উৎসবে রূপ লাভ করেছে।

চারুকলার ছাত্রদের ভুভুজালা মিছিল (মঙ্গলযাত্রা) এবং রমনার বটমূলে পান্তা ইলিশ ভোজ এখন কোন ভাবেই আটকানো যা”েছ না। ছায়ানটের বর্ষবরণ আজ বাঙালির ভোরের আরাধনা হয়ে পড়েছে। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি প্রবাহমান ধারায় আজ সর্বজনীন উৎসবে উৎসবে মধুময় হয়ে ওঠেছে। এ যে বাঙালি জাতিকে সামনে অনেক দূর নিয়ে যাবে।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD