শনিবার, ২৭ Jul ২০২৪, ০১:৪৪ অপরাহ্ন

রাইসির হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ যেভাবে খুঁজে পেল ড্রোন

রাইসির হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ যেভাবে খুঁজে পেল ড্রোন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ‌ইব্রাহিম রাইসির হেলিকপ্টার রোববার ‘হার্ড ল্যান্ডিং’ অর্থাৎ বিপজ্জনকভাবে অবতরণ করেছে এমন খবর পাওয়ার পর, বেশ কয়েকটি অনুসন্ধানী ও উদ্ধারকারী দল দুর্ঘটনাকবলিত হেলিকপ্টারটির খোঁজে কয়েক ঘণ্টা ধরে বন ও পাহাড়ি এলাকায় চিরুনি অভিযান চালায়।
তবে ঘন কুয়াশা ও বৃষ্টির কারণে দুর্ঘটনাস্থল ও এর আশেপাশের দৃষ্টিসীমা মাত্র পাঁচ মিটারে নেমে এসেছিল। এমন অবস্থায় উদ্ধারকারী দলগুলোকে ভীষণ অসুবিধায় পড়তে হয়। ইরানি কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, রাইসি রোববার (১৯ মে) আজারবাইজান-ইরানের সীমান্তে একটি বাঁধ উদ্বোধন করে তার দেশের তাবরিজ শহরের দিকে ফিরছিলেন। এ সময় পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের জোলফা অঞ্চলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সে সময় ওই হেলিকপ্টারে রাইসির সঙ্গে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আরও ছয়জন আরোহী ছিলেন।
হেলিকপ্টারটি উড্ডয়নের কয়েক মিনিট পর, ঘন কুয়াশা ও বৃষ্টির কারণে জোলফায় বিধ্বস্ত হয়। হার্ড ল্যান্ডিংয়ের খবর পেয়ে ইরানের প্রতিবেশী দেশ তুরস্ক, ইরাক ও আজারবাইজান এগিয়ে আসে এবং সম্মিলিতভাবে ব্যাপক অনুসন্ধান অভিযান শুরু করে। ইরানের সরকারি বার্তা সংস্থা ইরনা জানিয়েছে, রেড ক্রিসেন্টের অপারেশন প্রধান রাজিয়া আলিশোন্দি বলেছেন, খারাপ আবহাওয়ার কারণে তল্লাশি দলের এগিয়ে যেতে অনেক অসুবিধা হয়েছিল। তিনি বলেন, অনুসন্ধান অভিযানে ড্রোন ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করা ছিল রীতিমতো অসম্ভব। এদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণা করে যে তারা ইরানের অনুরোধে রাইসির হেলিকপ্টার শনাক্ত করার জন্য কোপার্নিকাস নামে তাদের ম্যাপিং সার্ভিস চালু করেছে। কোপার্নিকাস সিস্টেম ‘স্যাটেলাইট ইমেজের’ মাধ্যমে ম্যাপিং করে থাকে। গভীর রাতে রেড ক্রিসেন্ট সদর দপ্তর থেকে ঘোষণা করা হয়, তুরস্কের ড্রোন ‘হটস্পট’ শনাক্ত করেছে। রেভল্যুশনারি গার্ডের একজন কমান্ডারও বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তুরস্কের পাঠানো ড্রোনটি রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের স্থান খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এলাকাটি স্ক্যান করার পর, ড্রোনটি একটি ‘থার্মাল সোর্স’ শনাক্ত করে এবং ওই অবস্থানের তথ্য ইরানি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। এটি ছিল তুরস্কের বায়রাকতার আকিনজি মডেলের একটি ড্রোন যা কয়েক ঘণ্টা অনুসন্ধানের পর সোমবার সকালে উত্তর-পশ্চিম ইরানে রাইসির হেলিকপ্টারটির ধ্বংসাবশেষ সনাক্ত করে। এটি একটি সশস্ত্র ড্রোন যা ৪০ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তে সক্ষম।
তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইরানি কর্তৃপক্ষ তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানোয় তারা একটি আকিনজি ইউএভি এবং একটি নাইট ভিশন কুগার ড্রোন পাঠায়। রাইসির হেলিকপ্টারটির অনুসন্ধান অভিযানে অংশ নেওয়ার জন্য ওই দুটি ড্রোন পাঠানো হয়। এছাড়া অনুসন্ধানে সহায়তায় ৩২ জন পর্বতারোহীর একটি দল এবং ছয়টি উদ্ধারকারী গাড়িও পাঠানো হয়। তুরস্কের পরিবহন মন্ত্রী আব্দুল কাদির ইউরাউলু বলেছেন, ‘ইরানের প্রেসিডেন্ট এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে হেলিকপ্টারে ভ্রমণ করছিলেন, সেখানে সিগন্যাল সিস্টেম চালু ছিল না বা সেরকম কোনো ব্যবস্থাই ছিল না।’ তিনি বলেন, বিমান দুর্ঘটনার বিষয়ে তুরস্কে একটি জরুরি গবেষণা ও সমন্বয় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে এবং ইরান সীমান্ত তার আওতায় আসে। সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমরা হেলিকপ্টারটির সংকেত খোঁজার করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সিগন্যাল সিস্টেম সম্ভবত বন্ধ ছিল বা হেলিকপ্টারটিতে সেই সিগন্যাল সিস্টেম ছিল না। এজন্য আমরা তাদের কোন সন্ধান পাইনি।’ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, তারা ইরান থেকে একটি কল পেয়েছেন, যাতে হেলিকপ্টারের সংকেত সনাক্ত করার জন্য সাহায্যের অনুরোধ করা হয়। আমরা একটি সংকেত খোঁজার চেষ্টা করেছি, যেটা আমরা কোনো অনুরোধ পেলেই করি। কিন্তু আমরা কোনো সংকেত পাইনি।
ড্রোনটির বৈশিষ্ট্য এবং হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়ার প্রক্রিয়া
বারাকতার আকানসি কীভাবে রাইসির হেলিকপ্টারটির অবস্থান সনাক্ত করেছিল তা জানতে, এই উন্নত ড্রোনটির বৈশিষ্ট্যগুলি জানা গুরুত্বপূর্ণ:
* বারাকতার আকানসি হল সর্বশেষ সশস্ত্র ড্রোন যা তুর্কি প্রতিরক্ষা সংস্থা-বায়কার ডিফেন্স তৈরি করেছে।
* বারাকতার ড্রোনের নির্মাতা বায়কারের নেতৃত্বে রয়েছেন দুই ভাই – প্রধান নির্বাহী হালুক বারাকতার এবং তার ভাই প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা সেলজুক বারাকতার। যিনি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের মেয়েকে বিয়ে করেছেন।
* প্রতিরক্ষা সংস্থাটির ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুসারে, বারাকতার আকিনজি একটি কৌশলগতভাবে উচ্চমানের প্রযুক্তি। এর অনন্য কাঠামো এবং পাখার ডিজাইনের কারণে এটি বিভিন্ন পেলোড বহন করতে সক্ষম।
* বায়রাকতার আকিনজিতে রয়েছে দুটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এভিওনিক্স যা সিগন্যাল প্রসেসিং, সেন্সর ফিউশন এবং রিয়েল-টাইম পরিস্থিতিগত সচেতনতা তৈরিতে কাজ করে।
* এই ড্রোনটি বায়রাকতার টিবিটু ড্রোন ট্যাকটিকাল ইউএভির আরেকটি সংস্করণ। তবে এটি তার শ্রেণির সবচেয়ে শক্তিশালী ইউএভিগুলোর মধ্যে একটি। এটি ছয় হাজার কেজি পর্যন্ত ওজন তোলার ক্ষমতা আছে এবং এটি ২৪ ঘণ্টা এবং ৪০ হাজার ফুট উচ্চতায় একযোগে উড়তে পারে।
* ড্রোনটিতে দুটি টার্বোপ্রপ ইঞ্জিন এবং ২০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত একটি ডানা রয়েছে। যার কারণে এটি বিস্তৃত পরিসরে অভিযান পরিচালনার প্রয়োজনীয় শক্তি পায়।
* এয়ার-টু-গ্রাউন্ড এবং এয়ার-টু-এয়ার অর্থাৎ আকাশ থেকে মাটিতে এবং আকাশ থেকে আকাশে হামলার জন্যও এই ড্রোন ব্যবহার করা যায়
* এই উচ্চ প্রযুক্তির মনুষ্যবিহীন ড্রোনটি মূলত ফাইটার জেটকে সহায়তা করার জন্য এবং বিভিন্ন অভিযান পরিচালনার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
* এটি এমন একটি ড্রোন যার মধ্যে ডুয়েল স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন সিস্টেম, এয়ার-টু-এয়ার রেডার, ইলেকট্রনিক সাপোর্ট সিস্টেম, অ্যান্টি- কোয়ালিশন রেডার এবং সিনথেটিক অ্যাপারচার রেডার প্রযুক্তি রয়েছে।
* ড্রোনটি যে সংস্থা তৈরি করেছে তাদের মতে, একটি ফাইটার জেট যা করতে পারে, এই ড্রোনটি তার সবই করতে পারে।
* এর দিক নির্দেশনা বা ন্যাভিগেশন সিস্টেমটি অভ্যন্তরীণ সেন্সর ফিউশন ব্যবহার করে তাই এর কোন কিছু খুঁজে বের করতে বা অবস্থান সনাক্ত করতে জিপিএসের প্রয়োজন নেই।
* তুরস্কের ড্রোন প্রযুক্তি সক্ষমতার ক্ষেত্রে বারাকতার অ্যাকশন ড্রোন বড় ধরনের অগ্রগতি বলে ধরা হয়।
* এর প্রস্ততকারকের একজন কর্মকর্তা স্থানীয় গণমাধ্যম মিডল ইস্ট আইকে জানিয়েছেন, আকিনজির অনেক উঁচুতে ওড়ার সক্ষমতা রয়েছে। সেইসাথে এর থারমাল টেকনোলজি রয়েছে যার মাধ্যমে হটস্পট সনাক্ত করা গিয়েছে।
* এসব সক্ষমতা থাকার কারণে ড্রোনটি প্রতিকূল আবহাওয়ায় এবং ঘন কুয়াশার মধ্যেও কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছে।
* তুরস্কের আনাদৌলু এজেন্সি জানায়, রোববার রাত ৮টায় ইরানের কাছ থেকে সাহায্যের অনুরোধ আসে, যা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এর পরে, কুগার ড্রোনটি অবিলম্বে তুরস্কের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ দিয়ারবাকির থেকে ইরানের সীমান্তবর্তী ভ্যান প্রদেশে চলে যায়।
* তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের এই ড্রোন ব্যবহারের জন্য রাত ১০টা ২০ মিনিটে প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে অনুমোদন পায়। ইরানের প্রস্তাব গ্রহণ করার পর, তুরস্কের এই ড্রোনটি তুরস্কের পূর্ব ব্যাটম্যান প্রদেশ থেকে রাত সাড়ে ১১টায় উড্ডয়ন করে।
* ড্রোনটি প্রতি ঘণ্টায় কমপক্ষে ৩৬১ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম এবং কম গতিতে এটি পুরো এলাকা স্ক্যান করতে পারে। তুরস্কের শহর ভ্যান থেকে ইরানের সীমান্ত অতিক্রম করে সোমবার রাত পৌনে একটায় এটি দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।
* স্থানীয় সময় আনুমানিক রাত ২টা ৩৬ মিনিটে আকানসি প্রথম হিট সিগন্যাল অর্থাৎ উত্তপ্ত কিছু আছে এমন সংকেত পায় এবং তথ্যটি অবিলম্বে ইরানি কর্তৃপক্ষের জানানো হয়। এরপর উদ্ধারকর্মীরা স্থানীয় সময় ভোর ছয়টার দিকে ধ্বংসস্তূপে পৌঁছায়।
* তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা এএ বলছে, ফ্লাইটরেডার ২৪ অ্যাপ্লিকেশনে লাখ লাখ মানুষ সরাসরি ড্রোনের রুট দেখেছে। একই সংস্থা ওই ড্রইং এর একটি ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করে।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD