বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১০:১১ পূর্বাহ্ন

প্রিয় লেখা: আমার রবীন্দ্রনাথ – সমরেশ মজুমদার

প্রিয় লেখা : আমার রবীন্দ্রনাথ

-সমরেশ মজুমদার

গত সোমবার ঢাকায় এসেছি। নিজস্ব কাজকর্মের বাইরে জানতে আগ্রহ ছিল, রবীন্দ্রনাথের দেড়শো জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশের মানুষ কী ভাবছেন!

প্রতিবার আমি ঢাকা ক্লাবে উঠি। যে ছেলেটি চা দিতে এল সে বেশ স্মার্ট, সুন্দর দেখতে। তার বুকে আটকানো ফলকের নাম বলছে সে মুসলমান নয়। হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছ?’

‘কোন রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর?’

রবীন্দ্রনাথ বললেই যাঁকে মনে করতে আমি অভ্যস্ত তার পদবি জানার কি প্রয়োজন হয়? ছেলেটি বলল, ‘স্যার, এই শহরে অন্তত চারজন রবীন্দ্রনাথকে আমি চিনি, কিন্তু তাদের কারও পদবি ঠাকুর নয়।’

‘হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।’

ছেলেটি এমনভাবে হাসল যেন আমি তাকে তার মামার কথা জিজ্ঞাসা করেছি, ‘উনি স্যার আমাদের দেশের লোক। এখানে তাঁর জমিদারি ছিল। খুব বড় কবি ছিলেন। আমাদের জাতীয় সংগীত তো তাঁর গান থেকে নেওয়া। তিনি এত বড় যে, জিয়া সাহেব, এরশাদ সাহেব এমনকী বেগম জিয়াও তাঁকে সমীহ করতেন।’

বাংলাদেশের তিন প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়কের নাম করল ছেলেটি। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এঁদের নাম করলে কেন?’

‘স্যার,বঙ্গবন্ধু যখন মুক্তিযুদ্ধের পর ক্ষমতায় এলেন তখন আমি জন্মাইনি। তিনিই জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পরে বিএমপি ক্ষমতায় এসে অনেককিছু পালটে দিয়েছে কিন্তু জাতীয় সঙ্গীত পালটায়নি।’

‘খামোকা পালটাবেন কেন?’

‘এখনকার নিয়মই হল আগের সরকার যেসব নামকরণ করে যাবে তা পরের সরকার এসে পালটে দেবে। অনেকবার এই পালটানো চলেছে কিন্তু জাতীয় সঙ্গীত একই থেকে গিয়েছে। এরশাদ সাহেব বা বেগম জিয়াও সাহস করেননি পালটাবার।’

‘তুমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা গল্প পড়েছ ?’

‘স্কুলের বইতে পড়েছিলাম। এখন তো টাইম পাই না।’

ছেলেটি চলে গেলে মনে হল, জলপাইগুড়ির কোনও হোটেল-বেয়ারাকে প্রশ্ন করলে সে হয়তো বলত, নাম শুনেছে কিন্তু তার বেশি কিছু জানে না। এই ছেলেটি অন্তত জানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়করা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামক একজন বিখ্যাত মানুষের লেখা গানকে বদলে দেওয়ার সাহস পাননি।

বাংলাদেশের মানুষকে একসময় তিনভাগে ভাগ করা হত। শতকরা নব্বুই ভাগ দরিদ্র, আটভাগ মধ্যবিত্ত এবং দুইভাগ প্রচণ্ড ধনী। গত দশ বছর এই মধ্যবিত্ত এবং ধনীদের ব্যবধান দ্রুত কমে গিয়েছে। তথাকথিত দরিদ্র মানুষদের একাংশ শিল্প সাহিত্য নিয়ে অবিরত চর্চার কারণে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। মধ্যবিত্ত এবং ধনীদের একাংশ শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। ফলে একজন কবি, লেখক, শিল্পী অথবা সাংবাদিককে কিছু ধনী অথবা মধ্যবিত্ত কাছের মানুষ বলে মনে করেন। প্রখ্যাত অধ্যাপককে সন্মান জানাবার সময় তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থানের কথা চিন্তা করেন না ধনী গুণগ্রাহক। ফলে একটি সংকর শ্রেণি তৈরি হয়েছে। ধরা যাক, আনোয়ার আলির কথা। যিনি বিশাল গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিক, কোটি কোটি টাকার গার্মেন্ট এক্সপোর্ট করেন, তিনি সন্ধ্যায় কবি সম্মেলনে যাচ্ছেন, আজকের গল্প-উপন্যাসের খবর রাখছেন। ফলে এঁদের একজন, ধরা যাক সামশের রহমান মিন্টু, অনায়াসে বলতে পারেন, ‘ রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বেঁচে থাকা আমার কাছে অর্থহীন। আর মন খারাপ হলেই আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনি।’

সৈয়দ সামসুল হক বাংলাদেশের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার। আমার সঙ্গে দীর্ঘকালের পরিচয়। সকালে ক্লাবে রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করার সময় তাঁকে দরজায় দেখতে পেয়ে খুশি হলাম। কবে এসেছি ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করার পর তিনি আমার টেবিলে বসলেন। বলে রাখা ভাল, মানুষটি তাঁর পছন্দ বা অপছন্দের কথা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে অভ্যস্ত। কম কথা বলেন এবং বলার সময় প্রতিটি শব্দ সুনির্বাচিত বলে মনে হয়।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দেড়শো বছরের রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এদেশে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে?’

‘শব্দটা প্রতিক্রিয়া না হুজুগ সেটা ঠিক করা দরকার। উত্তর দিচ্ছি, তার আগে বলো, তোমার কাছে তিনি কীভাবে বাস করেন?’

হেসে বললাম, ‘ দেখুন, ধর্ম শব্দটির প্রথম দুটি অক্ষর যদি ধরা হয় তা হলে এখন পর্যন্ত আমি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কাউকে ধরতে পারিনি। জন্মসূত্রে আমাকে হিন্দু বলা হবে। আমার পিতা, পিতামহ, তাঁর পিতা যেসব পুজো বা অনুষ্ঠান করতেন তার একটাও আমি শৈশব থেকে করিনি। উলটে একটু বড় হয়ে মাকে প্রশ্ন করেছি, পুরোহিত যে মন্ত্র আউড়ে পুজো করে গেল তা তাঁর বোধগম্য হয়েছে কি না। আমাদের প্রজন্মের বেশিরভাগ মানুষের বাড়িতে ঠাকুরঘর নেই, পরের প্রজন্ম তো এ নিয়ে ভাবে না। বারোয়ারি পুজোগুলো তো নেহাতই বিনোদনের কারণে। বড় হয়ে বুঝেছি যেহেতু আমাদের একটা কোরান বা বাইবেল নেই তাই জীবনযাপনে শৃঙ্খলাবোধ আসেনি। অত্যন্ত অশান্তির সময়ে সান্ত্বনা বা শান্তি জোগানোর কেউ নেই। তিরিশ পার হওয়ার পর সেই অভাব দূর করলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর প্রবন্ধ এবং গান আমার বন্ধু হয়ে গেল। বুঝতেই পারছেন। আমার ধর্মের নাম রবীন্দ্রনাথ।

‘বেশ, তোমার প্রশ্ন শোনা যাক।’ সৈয়দ সামসুল হক বললেন।

‘আপনি মুসলমানদের মধ্যে ব্রাহ্মণ। আপনার জীবনে কোরানের কোনও বিকল্প নেই। আবার অন্যদিকে আপনি কবিতা, উপন্যাস, নাটকে মানুষের কথা বলেন। সেই মানুষ ধর্মবিশ্বাসী না হলেও আপনার কলমে রক্তমাংসের। এই আপনার জীবনে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা কতখানি?’

তাঁর দুটো হাত পরস্পরকে ছুঁয়েছিল, এবার একটা হাত শূন্যে দুলিয়ে তিনি বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমাকে একটা আকাশ দিয়েছেন। সেই আকাশ আমার নিজের। আমার সুখদুঃখ, প্রেম-অপ্রেম, সেক্স অথবা অতীন্দ্রিয় অনুভূতি নিয়ে সেখানে আমি স্বচ্ছন্দে বিরাজ করতে পারি। এর সঙ্গে আমার আচরিত ধর্মের কোনও বিরোধ নেই। আমার পিতামহ শুধু নামেই সৈয়দ ছিলেন না, তিনি প্রবল ধর্মরসে ডুবে ছিলেন। কিন্তু আমার পিতা সেদিকে না গিয়ে ডাক্তার হতে চাইলেন। এই কারণে পিতামহ পিতাকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। পিতা কলকাতার নাখোদা মসজিদের পাশে তাঁর প্র্যাকটিস শুরু করেন। একদিন পেশেন্ট ছিল না, পিতা ঘরের বাইরে এসে দেখলেন শেষ সূর্যের আলোয় আকাশ কী করূণ হয়ে উঠেছে। তখনই তাঁর মনে হল, তিনি সময়ের অপচয় করছেন। পরের দিনই চলে গেলেন বাংলাদেশের এক অজ পাড়াগাঁয়ে। সেখানে গরিব মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ালেন ডাক্তার হিসেবে। এই যে এক বিষণ্ন আলো দেখে মন বদলে যাওয়া, রবীন্দ্রনাথ বারংবার আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেন। কোরানে ঈশ্বর তুলনা দিতে গিয়ে গাছ, নদী ইত্যাদির কথা বলেছেন। কিন্তু ওগুলো তো তাঁরই সৃষ্টি। মানুষ যাদের কথা বলবে ঈশ্বর তাদের কথা বলায় তিনি আমাদের কাছের মানুষ হয়ে গিয়েছেন।

এসবই তো রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি। আমি শিখলাম, ‘আমার এ ঘর বহু যতন করে/ ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।’ এই শেখাটা যদি জীবনে কাজে লাগাতে পারি তা হলে এই জীবনটা ঠিকঠাক কাজে লেগে যাবে। কিন্তু আমি তারপরের লাইনের সঙ্গে সহমত নই, ‘আমারে যে জাগতে হবে/কী জানি সে আসবে কবে/ যদি আমায় পড়ে তাহার মনে।’ কেন? আমি তো তৈরি হয়ে গিয়েছি, তিনি আসবেন, আমাকে মনে পড়লে আসবেন বলে অপেক্ষা করব কেন? তিনি তো আমার মধ্যে অথবা আমি তাঁর মধ্যে বাস করছি। সমরেশ, ঘুমের ওষুধে আমার ঘুম আসে না। রোজ রাত্রে তাঁর গান বাজাতে হয়। কথাগুলো সুরের সঙ্গে মিশে গিয়ে কখন আমায় ঘুম পাড়িয়ে দেয়, টের পাই না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে কয়েকটি ছেলেমেয়ে আড্ডা মারছিল। চিনতে পেরে তারা আমাকে ঘিরে ধরল অটোগ্রাফের জন্যে। বললাম, ‘নিশ্চয়ই দেব, কিন্তু তার আগে বলো, তোমরা কজন রবীন্দ্রনাথ পড়েছ?’

মুখ চাওয়াচাওয়ি করল ওরা। কিন্তু একটি মেয়ে বলল, ‘পড়িনি তেমন, কিন্তু শুনেছি। শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। আমি অন্তত দেড়শো গান বলতে পারব, গাইতে পারব না।’

‘কেন?’

‘আমার গলায় তেমন সুর নেই।’

‘তাহলে এতবার শুনলে কেন? কেন মুখস্থ হল?’

‘কেন হবে না? কেউ কি লিখতে পারবে, ‘ওরে আকাশ ভেঙ্গে বাহিরকে আজ নেব রে লুট করে।’ আকাশকে ভাঙ্গা এবং সেই সঙ্গে লুট করা, বাঙলা গানে? এখন যারা ব্যান্ডের গান গায় তারা পারবে লিখতে? মেয়েটি স্পষ্ট বলল।

অন্যদের দিকে তাকালাম, ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা গল্প-উপন্যাস, তোমরা যদি না পড়ো তা হলে এই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলো কী করে?’

মেয়েটি হাসল, ‘আমি ওদের বলি, আমায় থাকতে দে না আপন-মনে।’

আবুদুল্লাহ আবু সাইদ বাংলাদেশে অতি শ্রদ্ধেয় নাম। সারা পৃথিবীতে মানুষকে গ্রন্থমুখী করার জন্যে তিনি বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্র তৈরি করেছেন। সেখানে একটু একটু পাঠকের সংখ্যা বাড়ছে। অধ্যাপনা ছেড়ে তিনি পাঠক তৈরির কাজে অনেকটা সাফল্য পেয়েছেন। কেউ বলেছিলেন সাইদভাই রবীন্দ্রবিরোধী। গত পরশু বিকেলে ঢাকায় কালবৈশাখি ঝড় বইছিল। তিনি আমাকে নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাবেন বলে গাড়ি নিয়ে এলেন। গাড়িতে ওঠা মাত্র বাজ পড়ল কোথাও। সাইদ সাহেব বললেন, ‘ বুঝি বা এই বজ্ররবে নূতন পথের বার্তা কবে/ কোন পুরীতে নিয়ে তবে প্রভাত হবে রাতি।’

অবাক হয়ে বললাম, ‘এ কী ভূতের মুখে রামনাম?’

চমকে উঠে বললেন, ‘মানে?’

‘শুনেছি আপনি নাকি প্রবল রবীন্দ্রবিরোধী?’

হাসলেন তিনি, ছিলাম। লিকলিকে লেজ দেখে বলতাম হাতিটা খুব রোগা। সেটা এমন একটা বয়স, যা সামনে তাঁকে নস্যাৎ করতে আনন্দ হত। তারপর যখন জানলাম ওটা ডোবা পুকুর বা দিঘিও নয়, বিশাল সমুদ্র, তখন থমকে গেলাম। তখন তো নতজানু না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু আমার মুশকিল হল আমি অন্যান্য রবীন্দ্রভক্তের মতো অন্ধ হতে পারি না। আমি বলি তিনি কেন তিনসঙ্গীর গল্প লিখলেন? শেষের কবিতাকে আমি কিছুতেই মূল্যবান উপন্যাস বলে ভাবতে পারি না। এমনকী সঞ্চয়িতার কবিতাগুলোর থেকে স্বচ্ছন্দে আর একটি সংকলন তৈরি করা যায়। আর এসবের পরেও তাঁর বিকল্প কেউ নেই।’

‘কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পড়েন কজন মানুষ?’

‘দেখুন, রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষের সময় যাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর লেখা পড়েছিলেন এখন অন্তত তার কয়েকশো গুণ বেশি পাঠক তৈরি হয়েছেন। যতদিন যাবে এই সংখ্যা বাড়বে। আপনি একজন কৃষক অথবা মজুরকে বাধ্য করতে পারেন না বই পড়তে। কিন্তু একজন শিক্ষিত মানুষ যদি না পড়েন তা হলে তাঁকে অশিক্ষিত ভাবতে আমাদের দ্বিধা থাকবে না।’

সেই রাত্রে ঢাকা ক্লাবে আড্ডার সময় একজন সদ্য পরিচিত বললেন, ‘দেখুন ভাই, আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমাদের মতো করে ভাবি।’

‘যেমন!’

‘আমার নাম ইমাদুল করিম মিঞা। উনি ডক্টর আশরাফ হোসেন। রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে সামসুল হক মোল্লা।’

চমকে উঠলাম, ‘সে কী? আপনি নামটাও বদলে দিয়েছেন?’

‘নো। নট অ্যাট অল। ট্রান্সলেট করে নিয়েছি।’

সামস শব্দের অর্থ সূর্য! উল মানে শ্রেষ্ঠ! হক মানে প্রভু, নাথ! আর মোল্লা হল ঠাকুর। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার কাছে সামসুল হক মোল্লা।’

আড্ডার সবাই যেভাবে হাসলেন তাতে কথাগুলো কোনও গুরুত্ব পেল না।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD