শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৪৬ পূর্বাহ্ন

নাজিম হিকমতের কথা – আহমেদ জহুর

নাজিম হিকমতের কথা – আহমেদ জহুর

নাজিম হিকমতের কথা - আহমেদ জহুর

নাজিম হিকমতের কথা

একজন কবি জেলে যেতে পারেন? অবশ্যই পারেন। কিন্তু কেমন হয় যদি তাঁর জীবনের বেশিরভাগটাই কাটে জেলখানার অত্যাচারে? কেমন হয় যদি তাঁর জেলে যাওয়া কোন ফৌজদারি অপরাধের জন্য নয়, বরং মানুষের কথা, অধিকারের কথা, সাম্যের কথা বলার অপরাধে তাঁকে বার বার অবরুদ্ধ করে রাখে, তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে একটি সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র?

তিনি কি দমে যাবেন? হারিয়ে ফেলবেন তার কলম, লিখবেন না আর কবিতা? নাকি শত অত্যাচারেও বার বার জেগে উঠবেন ফিনিক্স পাখির মতো। নির্ভীক উচ্চারণে বলে উঠবেন, “নাজিমের নীল চোখে ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে ভয়।”

হ্যা বন্ধুগণ, আমি কবি নাজিম হিকমতের কথাই বলছি, তিনি মানুষকে ভাবতেন পাখির মত সরল। পাবলো নেরুদা বলেছিলেন, ‘সদ্য মুক্তি পাওয়া বন্দীদের একজন নাজিম হিকমত তাঁর কবিতার মতো লাল রং সোনার সুতায় বোনা জামা উপহার দিয়েছে আমায়।’

নাজিম হিকমতের কথা বলতে গেলেই অবধারিতভাবে যে নামটি আসে তা হলো মুস্তফা কামাল পাশা। প্রথমে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গী ও পরে শ্রেণিশত্রুতে পরিণত হওয়া এই খলনায়ক মূলত প্রতিনিধিত্ব করছিলেন তাঁর নিজের শ্রেণিরই। নাজিম তাই কলম ধরেছিলেন এই শ্রেণি বিভক্ত সমাজের বিরুদ্ধে।

তুরস্কের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার পর একটা সময়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবপরবর্তী সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বচক্ষে দেখতে তিনি জর্জিয়ায় গিয়েছিলেন, সেখান থেকে মস্কো। সেখানকার কম্যুনিস্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করার সময় তিনি পরিচিত হন মার্ক্স-লেনিন তথা সর্বহারার মহান মতবাদের সঙ্গে।

১৯২৪ সালে তুরস্ক স্বাধীন হবার তিনি দেশে ফিরে আসেন এক বুক স্বপ্ন নিয়ে। শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্যহীন এক পৃথিবী গড়ার কাজে লেগে পড়েন ফিরেই। ধীরে ধীরে বড় করে তোলেন তাঁর সুন্দর শিশু মনকে। কিন্তু যে রাষ্ট্র গণমানুষের নয়, যে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা লাভে কেবল মাত্র শোষকের পরিবর্তন হয়েছে, এ শিশুর বেড়ে ওঠা তার জন্য হুমকির, তার জন্য ভীতিকর।

কারণ সে জানে, ঘুমন্ত নিপীড়িত মানুষ একবার জেগে উঠলে সে আর পালাতে পারবে না। আর কোন মুখোশ তাকে বাঁচাতে পারবে না। তাইতো তারা গ্রেফতার করতে চায় নাজিম হিকমতকে। তখন গ্রেফতার এড়াতে তিনি চলে যান রাশিয়ায়।

১৯২৮ সালে সাধারণ ক্ষমা করলে দেশে ফেরেন তিনি। ততদিনে অবশ্য শাসকগোষ্ঠী নিষিদ্ধ করেছে তুরষ্কের কম্যুনিস্ট পার্টিকে। ছড়িয়ে দিয়েছে গুপ্তচর। চলছে প্রচন্ড ধরপাকড়। কী তীব্র তাদের ভয়! এজন্যই সম্ভবত ম্যাক্সিম গোর্কি লিখেছিলেন, ‘আমাদের উজ্জীবিত আত্মাকে মারতে পারবে না ওরা।’ থেমে থাকেননি নাজিম। হয়ে ওঠেন লাঞ্ছিত নিপীড়িতের কন্ঠস্বর। তুরস্ক সরকার তাই তাঁকে পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় জেলে রাখে।

১৯৩৮ সালে সেনাবাহিনীতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অনুপ্রেরণা যোগানোর অপরাধে তাঁকে জেলে পাঠানো হয় ২৮ বছরের জন্য। একবার ভাবুন, কী পরিমান শোষক রাষ্ট্র হলে জনতার ন্যায্য দাবি প্রচারের দায়ে একজন কবির ওপর নামিয়ে আনে অত্যাচারের স্টিমরোলার। এই দফায় জেলখানার কাটানো সময়গুলোতে তিনি সম্ভবত রচনা করেছিলেন তার মহত্তম স্মৃষ্টিগুলো। মানুষের দুঃখ, আশা তাঁর কবিতায় কৃষ্ণচুড়ার মতো লাল। জেলখানার চিঠি ঘিরেছিলো চৌদ্দ শিকের প্রতিটা গরাদ….


‘মানুষের মুন্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়, ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে।’ কী সহজ অথচ দুঃসাহসী উচ্চারণ। কী অপরিসীম বিশ্বাস মানুষের প্রতি। তিনি বলেছিলেন, ‘দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে’।

১৯৫০ সালে তাঁর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করেন পাবলো নেরুদা, পল রবসন এবং জ্যা পল সার্ত্রে। ওই বছর পাবলো নেরুদার সাথে যৌথ ভাবে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন। তখন তিনি অনশন শুরু করেন।

তুরস্কের গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসলে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু গণতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্র কেবল নামেরই পরিবর্তন। যদি না সে সরকার হয় মানুষের, যদি না সে সরকার হয় জনতার। দু’বার হত্যা চেষ্টার পর তিনি আবার চলে যান সোভিয়েত ইউনিয়নে। এসময় তুরস্ক সরকার তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করে।

নাজিম হিকমত জন্মগ্রহণ করেন ১৯০২ সালের ১৫ জানুয়ারি তুরস্কে। ১৯৬৩ সালের ০৩ জুন মস্কোয় মারা যান বিংশ শতকের অন্যতম কবি নাজিম হিকমত, পৃথিবীকে যিনি দেখতে চেয়েছিলেন সব থেকে সুন্দর সমুদ্রের মতো।

© আহমেদ জহুর
কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

 

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD