আমরা আবেগপ্রবণ বাঙালি জাতি । শুধু আবেগ বললেও ভুল হবে, বরং অতি-আবেগি৷ গত কয়েকদিন যাবৎ সোশ্যাল সাইটগুলোতে খুব হাইপের সাথে একটা বিষয় হাইলাইট হচ্ছে- “১০ম শ্রেনির কোনো এক স্টুডেন্ট, একটা Oxygen concentrator বানিয়েছে” ভালো কাজ।
এই কাজের জন্যে তার কিছু ধন্যবাদ ও সহানুভূতি পাওয়াটা স্বাভাবিক। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু, এই এক কাজকে রঙে রাঙিয়ে “বিজ্ঞান প্রজেক্ট” হিসেবে নাম দেয়া, “সরকারি অর্থসহায়তা”র আবেদন করা, একটা “সায়েন্টিস্ট সায়েন্টিস্ট ভাব” নিয়ে খবরের কাগজগুলোতে পোজ দেয়া- এগুলো ঘোর প্রতারণা; জাতির সাথে প্রত্যক্ষ্য চিটিং! প্রকৃত মেধাবীদের অপ্রকাশিত মেধায় হাতুড়ির কশাঘাত!
💠 কয়েকটি স্টেপে বিষয়টি পর্যালোচনা করা যাকঃ
◾ পরিচিতিঃ
সহজভাবে, Oxygen concentrator- হল এমন একটা যন্ত্র যা অক্সিজেন তৈরি করতে পারে। সেটা হতে পারে কোন ক্যামিকেল থেকে, পানি থেকে অথবা বায়ুমন্ডল থেকে। এটি সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন “Union Carbide Corporation” ১৯৬০ সালে! (অবাক হয়েন না 🙂) এবং বায়ুমন্ডল ভিত্তিক যন্ত্রটি উদ্ভাবিত হয় ১৯৭০ সালে Bendix Corporation এর আদলে। অর্থাৎ আজ থেকে (৫০-৬০) বছর আগের কাহানী! বর্তমানে এর আরো অনেক অত্যাধুনিক ভার্শন, জেনারেল মেডিকেল মার্কেট গুলোতেই এভেইলেবল। আর অনলাইন তো আছেই! বাংলাদেশের বাজারে এয়ার-অক্সিজেন-কনসেনট্রেটরের প্রাইজ এরাউন্ড ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজারের মধ্যে। [নিজ দায়িত্বে চেক করতে পারেন 😐]
◾ প্রস্তুতপ্রনালীঃ
বাংলাদেশে প্রতিবছরই বিভিন্ন বিজ্ঞান প্রজেক্ট মেলার আয়োজন করা হয়। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন প্রতিটি আয়োজনের ৮০% ই তাদের প্রজেক্ট তৈরি করে মহাপ্লাটফর্ম Youtube এর অবদানে! আমার এক বন্ধু নেপোলিয়ন এর উক্তিটি মজা করে বলত, “আমাকে একটি ইউটিউব দাও, আমি তোমাকে একটি বিজ্ঞানী জাতি দিব🙂”। আসলেই বাস্তবিক পরিস্থিতি এমনই। ৮০% এর চকচকা-ফকফকা কপি প্রজেক্টের চাপে ২০% মেধাবীর মস্তিষ্কপ্রসূত উদ্ভাবন প্রতিনিয়তই চাপা পরে যায়। যাইহোক, এ নিয়ে পরের স্টেপে বলব। এখন চলুন ভাইরাল এই “অত্যাধুনিক-পুরাতন” প্রজেক্টটির পিন্ডি চটকিয়ে আসি-
কমপ্রেসর (ফ্রিজের পশ্চাৎদেশে দৃষ্টি দিন)
◾ বঙ্গদেশে এত হাইপ ক্যান?:
এতই যদি সোজা কাজ, তাহলে এ জিনিস নিয়ে বাংলায় এত তোলপাড় কেন? উত্তর আপনিই জানেন, “বাংলায় ২ টা জিনিস খুব সস্তা, তাই সবাই ব্যবহার করে। এরা হলো- টিস্যু আর ইস্যু”। এটাও একটা নতুন ইস্যু্। তাছাড়া ৫০-৬০ বছর আগে ইনভেন্টেড হলেও ডাক্তার আর প্রফেশনালরা বাদে সাধারণ পাবলিক এটার সাথে সদ্যই পরিচিত হয়েছে। তাই, এত তুমোল জোয়াড়। করার কিছুই নেই। আপনিও মেধাটাকে ছুড়ে ফেলে ” ইউটিউব সাইন্টিস্ট ফোরামে” যোগ দিয়ে জোয়াড়ে ভেসে যান।
◾ ইনভেন্টর vs মেকানিকঃ
আবিষ্কারক এবং কারিগরের মধ্যকার তফাৎটা আমরা এদেশে অনেক কমই বুঝি। কেউ সাধারন মানুষের অজানা একটা কিছু তৈরি করে ফেললেই আমরা নির্বিচারে বিজ্ঞানী, আবিষ্কারক ইত্যাদি তকমা দিয়ে দেই। যেটা কিনা জাতির সাথে প্রতারনা। একজন তার মাথা খাটিয়ে, অনেক চিন্তার পর নতুন একটা কিছু ইনভেন্ট করেছে। আরেকজন ঐ মডেলেই কিছু যন্ত্রাংশ জোড়া লাগিয়ে, ঐ বস্তুটাই তৈরি করেছে৷ প্রথমজন আবিষ্কারক (inventor), দ্বিতীয়জন কারিগর (mechanic)। তাদের সম্মাননার দূরত্ব আকাশ-পাতাল; কিন্তু আমরা উভয়কে মিশিয়ে গুলিয়ে এক করে ফেলি!
💠 যাইহোক, “কয়েকটা পার্টস জোড়া লাগিয়ে বিজ্ঞানী বনে যাওয়া এসকল Youtoube scientists”দের তাদের লিমিট পর্যন্ত হাইলাইট করা যায়। কিন্তু আবেগপ্রবণ বাঙালি সহসাই এ লিমিট অতিক্রম করে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে যাচ্ছে, যাতে করে ভবিষ্যত প্রজন্মের নিজস্ব মুক্তচিন্তাকে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে! হয়ত বাংলার এমন দিন খুব বেশি দূরে নয় যখন ছেলেরা অনলাইনে সার্চ করবে- “how to eat”, “how to drink”….বাংলার জনতা এটাকে প্রযুক্তির উন্নয়ন ও শিক্ষার প্রসার নাম দিতে পারে, তবে প্রকৃতপক্ষে সেটা হবে শিক্ষা ও মেধার জবাই। সময় আসবে সময় যাবে। সময়ের স্রোত থেকে আপনি কাকে গ্রহন করবেন, কাকে বর্জন করবেন সেটা সম্পূর্ণ আপনার নিজস্ব রুচি। তবে অনুরোধ, প্রত্যেককেই তার প্রাপ্য পর্যন্ত দিন। প্রাপ্যের চেয়ে বেশি দিয়ে প্রকৃত মেধাকে মাটিচাপা দিয়েন না।
আরাফ আল রাফি
Leave a Reply