শনিবার, ২৭ Jul ২০২৪, ০৬:২২ পূর্বাহ্ন

ঘের : নাসরীন খান

মর্জিনা সারাটা দিন কষ্ট করে যে কয় টাকা লাভ পায় তা দিয়ে মেয়ের পড়ার খরচ চালায় আর কোন রকমে আধপেটা খেয়ে দিন পার করে। ব্যবসা মাঝেমাঝে ভালই চলে। মাঝে মাঝে এত মন্দ যায় যে বাজারের টাকাও হয় না। হরতাল আর অবরোধ চললে বেশী  ক্ষতি হয়। সারাটা দিন চিন্তা হয় বাচ্চা দুইটার জন্য । কলেজে ঠিকমতো যায় কিনা , ঠিক সময় বাসায় ফিরে  কিনা। ছেলেটা মর্জিনার সাথে সাথেই থাকে। বয়স ৮বছর। আগে মর্জিনা গার্মেন্টে চাকুরি করত । বেতনও ভালই পেত। স্বামী-স্ত্রী আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখের সংসার ছিল। জামাই হঠাৎ করে একটা বাজে মেয়ের পাল্লায় পড়ে সংসার ছেড়েছে। সেই মেয়েকে বিয়ে করে অন্যত্র ভাড়া থাকছে। আগে বাচ্চার বাপ এসে প্রতিদিন দুই তিনবার করে দেখে গেছে ছেলেটা কী খাচ্ছে, কী করছে। রাজমিস্ত্রির সাথে যোগালির কাজ করতো বলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে সংসারের খোঁজ নিতে পারত। মর্জিনার তাই গার্মেন্টে কাজ করা সম্ভব ছিল। ছেলেটা ছোট বলে তাকে খেয়াল রাখতে হয়। বাজে ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করে  সিগারেট, গাজার নেশায় পড়ে যেতে পারে। অথবা ছেলেধরায় নিয়ে যেতে পারে। বাচ্চা দুইটার দিকে তাকিয়ে মর্জিনা ভেবে পায় না এ রকম দুইটা বাচ্চা রেখে পুরুষ মানুষটা কেমনে পারলো আরেকটা  ঘর পাততে। ওদের চেহারাটা চোখের সামনে কেন ভেসে উঠল না? নিজের সন্তানদের জন্য কোনও মানুষের টান না থাকে? তার কাছে অবাক লাগে। তখন তারে আর  মানুষ মনে হয় না; জানোয়ার মনে হয়।

একটা ভ্যান যোগার করে বাজার থেকে কম দামে কাপড় এনে একটু লাভে  বিক্রি করে সংসার আর বাচ্চাদের হাল ধরেছে। বাচ্চা দুইটা একদিন বড় হবে , চাকরি করবে। বড় চাকরি না হোক ছোট চাকরি করুক তবু তো চাকরি। সে ভাবে তার  মত ভ্যানে করে কাপড় যেন না বেচতে হয়। আর বদমাইশ বাপটার মত যোগালি যেন না হয়।

ভাবতে ভাবতে কত কথা যে মনে হয় মর্জিনার-

ভ্যানে কইরা কাপড় বেচি , চুরি বাটপারী তো করি না। তবু ব্যাটারা মেয়ে মানুষ দেইখা টিটকারি দেয়।

মাঝে মাঝে পাওথনে জুতা খুইলা মুখে মারতে মন চায়। মেয়ের বয়সী ছ্যামরায় কয়

– কাপড় বেইচ্চা কত পাও? আমার সাথে থাকলে এর চেয়ে বেশি পাইবা।

– নিজের কানরে বিশ্বাস করতে পারি নাই পরথমে। নিজের রাগটারে মাডি দিয়া কইলাম

– বাবা ,আপনে কিছু নিবেন? আমার মেয়ে আমনের বয়েসী।

– হ বুজজি! তুমি বেশি চালাক। তয় কয়দিন এমনে চলবা?

– আত-রথ যে কয়দিন ভাল থাহে সেই কয়দিন চলুম, নাইলে ভিক্ষা করুম। তাউ বেইজ্জত  যেন না বানায় আল্লায়।

প্রায়ই ছেলেটা ঘুরতে ঘুরতে ভ্যানডার সামনে আইসা আকারে ইঙ্গিতে আজে বাজে কথা কয় ।মাঝে মধ্যে মন চায় জুতাটা দিয়া গালটায় একটা দেই। কিন্তু দিলে তো আমার ব্যবসা পাতি গুটাইয়া না খাইয়া মরতে অইব। মেয়েটা দুইটা টিউশনি করে, আর আমি যা কামাই তাই দিয়া সংসার চালাই।

আমাগো লাইগ্যা আইন কানুন কিছুই নাই। কার কাছে বিচার দিমু। যহন দেখমু আমার স্বামী থাইকাও নাই তহন সেও মন্দ কথা কইতে ছাড়ব না। পুলিশ হউক আর কমিশনার হউক হগলতেই আমার জন্য সমান। মাইয়া মানুষরে একলা দেখলে অমানুষগুলার জিলবা দিয়া লালা পড়ে । তেঁতুলের টক দেখার লাহান।

মানুষ হউক আর অমানুষ হোক সমাজে চলতে ফিরতে স্বামী সাইনবো্ট্টা যেন থাকনই লাগব। পুরুষের পরিচয়খান কেন এত জরুলী? বিয়া করুক আরও তিনখান, বউরে পত্যেক  দিন ঐত্যাচার করুক, পিডাইক তাও একা থাকন যায় না কুনু ম্যায়া মাইনষের। ক্যান হকুনের মত খাবলাইয়া ধরতে আহে সুযোগ পাইলেই।

ধর্মের ভয় নাই, আল্লার বিচারের ভয় নাই। মনুষ্যত্বের বোধটা নাই। তাইলে বউয়ের কথা ছাড়া দ্বিতীয়বার বিয়াও করত না। এক বউ, বাচ্চা গো  যে ঠিকমতন খাওন দাওন দিতে পারে না, সে আবার বিয়া করে ক্যামতে। খোঁজ খবর নিলে দেহন যাইব, যেই বেটা আমারে বিরক্ত করতাছে সেই বেটাও নিজের বউরে ঠিকমতন দেহাশুনা করে না। সমাজটা যে কবে ঠিক অইব। সব পুরুষগুলাইন মানুষ অইব, নারীরে সম্মান দিব। এই দুনিয়াডা একটা ঘের বানাইয়া রাখছে পুরুষ মানুষগুলা। মেয়ে মানুষ হ্যানে বন্দী। ঘরে যন্ত্রণা তো আছেই, বাইরেও তাগো অত্যাচার। শান্তিতে কামাই রোজগারও করণ যায় না।

গারমেন্টে যহন ছিলাম তহনও দেখছি, হকুনের চোখ যেমন মরা জন্তু খোঁজে তেমনি পুরুষ মানুষগুলা সুযোগ পাইলেই মেয়ে মানুষ খুঁইজ্জা বেড়ায়। যারা সত্যিকারের ভালা তাগো চোখ দেখলেই বোঝা যায়। হেই পুরুষের সংখ্যা খুবই কম। তারা ঘরের মানুষটারে ভালাওবাসে, আবার সম্মানও করে। মাঝে মাঝে এই খারাপগুলার অত্যাচারে খুব মন খারাপ অয়, মেজাজও খারাপ কিন্তুক করনের কিছুই নাই। যতদিন না হেগো মনটা ভালা মানুষ অইবার চাইব, ততদিন আমাগো কষ্টও দূর অইব না। সেই দিন আদৌ কি আইব?

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD