শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৩৮ পূর্বাহ্ন

কাকে বলে মহৎ লিখন – গৌতম মিত্র

কাকে বলে মহৎ লিখন – গৌতম মিত্র

কাকে বলে মহৎ লিখন - গৌতম মিত্র

কাকে বলে মহৎ লিখন  ? একটি সফল টেক্সটের লক্ষণ কী?কীভাবে একটি লেখা কালজয়ী হয়ে ওঠে?এইসব কূটতর্কে যাচ্ছি না।

আমি বরং একটি স্বরাট উপন্যাস গড়ে ওঠবার নেপথ্যে একজন ঔপন্যাসিকের পথরেখা ও শ্রমটুকুর কথা বলি।

পেরুর নোবেলজয়ী লেখক মারিও ভার্গাস ইয়োসাকে তাঁর ‘দি ফিস্ট অফ দ্য গোট’ উপন্যাসে এত নিষ্ঠুরতা কেন এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ইয়োসা উত্তর দিয়েছিলেন :

আমি ডমিনিকান প্রজাতন্ত্র দেশটিতে এই উপন্যাসটি লেখার জন্য বেশ কয়েকবছর ছিলাম।এবং আমি স্বৈরাচারী শাসক রাফায়েল ট্রুজিলোর নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে যা তথ্য সংগ্রহ করেছি তার মাত্র পনেরো শতাংশ উপন্যাসে ব্যবহার করেছি।

‘মাই নেম ইজ রেড’ লেখার সময় পামুকের কাছে সব থেকে বড়ো সমস্যা ছিল সংগৃহীত তথ্যের কতটা বাতিল করবেন।ইন ফ্যাক্ট লেখা শুরুই করতে পারছিলেন না এই দোলাচলে।’ইউলিসিস’ লেখার সময় জয়েসের বাতিল নোটের পরিমাণ আজ প্রবাদপ্রতিম।

লেখা মানে সবকটি তাস বা সবকটি তির ব্যবহার করা নয়।বরং কিছু তাস আস্তিনে লুকিয়ে রাখা বা কিছু তির তূণে আড়াল করে রাখা একজন প্রকৃত লেখকের কাছে কাছে সব থেকে বড়ো চ্যালেঞ্জ।

আমি সামান্য একজন লিখিয়ে।গত ২০/২২ বছর ধরে জীবনানন্দ চর্চার নামে আসলে শিক্ষানবিশ। কাল রাতে কাজ করতে গিয়ে হঠাৎই চোখে পড়ল এই কুড়ি বছরে আমার সংগৃহীত তথ্যের দিকে।

আরে! দু’দুটো,যত নগন্যই হোক, বই লিখে ফেললাম, অথচ এই সংগ্রহীত তথ্যের সিকিভাগও ব্যবহার করলাম না! সব থেকে বড়ে কথা, কোনওদিন কি আদৌ ব্যবহার করব? জানি না!অথচ কেমন যেন ভরাট আমি, কোনও আক্ষেপ নেই!দিস্তা দিস্তা কাগজে কোথাও যেন শুধু আমার অল্প মায়া ছড়িয়ে আছে!

কত ইন্টারভিউ, লাইব্রেরি লাইব্রেরি ঘুরে খাতাভর্তি নোটস, যেখানে যত বই পেয়েছি — সামান্য সূত্র থাকলেও ঝাঁপিয়ে সংগ্রহ করেছি।মনে পড়ে: আমাদের গেছে যে দিন /একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি… রাতের সব তারাই আছে/দিনের আলোর গভীরে।

একটামাত্র উদাহরণ দেই।জীবনানন্দ দাশ তাঁর ডায়েরিতে, বারবার জ্ঞানবাবুর চায়ের দোকান, হরতালের দিন জ্ঞানবাবু কি করছেন, জ্ঞানবাবুর চালচলন কথাবার্তা, টুকে রাখছেন।হয়তো ভবিষ্যতে গল্প, কবিতা বা উপন্যাস লিখবেন বা লিখেছেন।

জ্ঞানবাবু সম্পর্কে আমার সংগৃহীত তথ্য।বর্তমান ঠিকানা ৭৯/১বি, মহাত্মাগান্ধি রোড।১৮৯৮-এ প্রতিষ্ঠিত।আসলে প্রেসিডেন্সি বোর্ডিঙের ব্যালকনিতে বসে জীবনানন্দ জ্ঞানবাবুর গতিবিধি লক্ষ করতেন।১৯২৯ থেকে ১৯৩৫ পর্বে, জ্ঞানবাবুর চায়ের দোকান রমরমিয়ে চলত।জ্ঞানবাবু মারা যান ১৯৪০-এ। ১৯৫০ -এ সেই চায়ের দোকান শিফট করে বর্তমানের ‘দিলখুসা কেবিন’!

জ্ঞানবাবুর নাম জ্ঞানেন্দ্রনাথ মল্লিক।তাঁর তিন ছেলে মনিকালা, বিলাসমোহন ও ননীলাল।মনিলালের তিন ছেলে।গৌতম, দীপক ও সৌরভ।আমি দীপক মল্লিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছি।বিলাসমোহন অবিবাহিত।ননীলালের এক ছেলে ইন্দ্রনীল।দাদুর কথা বলতে বলতে দীপকবাবুর চোখ চকচক করে উঠল।ভোর চারটায় দোকান খুলতেন।চলত রাত অবধি।

জীবনানন্দ দাশের সৃষ্ট চরিত্ররা কেউ-ই মিথিক্যাল বা ঐতিহাসিক নয়।এই পৃথিবীর ধুলোমাটিজলবাতাস মাখা রক্তমাংসের মানুষ।তবে এরা সরাসরি আসে না।১৯৩০-এ জীবনানন্দ লিখছেন, টেক্সট নির্মাতা চান বা না চান তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা প্রয়োজন হলে তাঁকে অমান্য করতে পারে।জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, ‘subtle points of view are more deserving.’ ‘subtle’ যদি নিগূঢ় হয়, জীবনানন্দ এক অপার বিস্ময়।

এই বিস্ময় নিয়ে এতগুলো বছর কেটে গেল।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD