বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৩০ পূর্বাহ্ন

ইংরেজি কবিতার ব্ল্যাংক ভার্স নকল করে মধুসূদন নাম দিয়েছেন ‘অমিত্রাক্ষর’

ইংরেজি কবিতার ব্ল্যাংক ভার্স নকল করে মধুসূদন নাম দিয়েছেন ‘অমিত্রাক্ষর’

ইংরেজি কবিতার ব্ল্যাংক ভার্স নকল করে
মধুসূদন নাম দিয়েছেন ‘অমিত্রাক্ষর’

|| কাজী জহিরুল ইসলাম ||

আমি যে কয়টি ভাষার কবিতা পড়েছি, যতটা বুঝেছি, আমার কাছে মনে হয়েছে ছন্দের ভিত্তি হচ্ছে ধ্বনি। আমার ধারণা পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই অক্ষরের ভিত্তিতে ছন্দ নির্ণীত হয় না। কারণ ছন্দটা প্রকৃতপক্ষে উচ্চারণের এবং শ্রবণের বিষয়, লেখার বা দেখার বিষয় না। শুধুমাত্র বাংলা ভাষায়ই অক্ষর গুনে গুনে ছন্দ নির্মাণের এই অদ্ভুত ব্যাপারটি আছে। বাংলা ভাষায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দের উৎপত্তি হয়েছে মধ্যযুগেই। কেউ কেউ মাইকেল মধুসূদন দত্তকে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের জনক এবং আধুনিক বাংলা কবিতার জনক বলেন, আসলে বাংলা ভাষায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দের উৎপত্তি আরো কিছুকাল আগেই হয়েছে। মাইকেলের বেশ কয়েকজন পূর্বসূরীর কবিতা থেকে কিছু পঙক্তি উদ্ধৃত করলেই তা পরিস্কার হবে। মধ্যযুগের কবি আলাওলের অনূদিত কাব্য পদ্মাবতীতে তিনি লিখেছেন, ‘প্রেম বিনে ভাব নাহি ভাব বিনে রস/ ত্রিভূবনে যত দেখ প্রেম হস্তে বস’। দুটি পঙক্তিই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে ৮+৬ পর্বে নির্মিত। মধ্যযুগের কবি মোহাম্মদ মুকিম লিখেছেন, ‘প্রেমরস কাব্য কথা সুগন্ধি শীতল/ কালাকাম ভাঙ্গি কৈলু পয়ার নিমল’। মধ্যযুগের আরো দুজন কবির কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিই, আব্দুল হাকিম লিখেছেন, ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’। দৌলত কাজী লিখেছেন, ‘মহামত্ত ঐরাবত দেখি কীর্তি যশ/ শ্বেতরূপে সুধর্মের হৈল পদ যশ’।

১৮ শতকের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর (১৭১২-৬০) এই ফর্মেই লিখেছেন, ‘অন্নপূর্ণা উত্তরিলা গাঙ্গিনীরে তীরে/ পার কর বলিয়া ডাকিলা পাটুনীরে/ সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটুনী/ ত্বরায় আনিল নৌকা বামাস্বর শুনি’।

সব ক’টি কবিতাই ৮+৬ মাত্রায় লেখা হয়েছে। মধুসূদনের কালে এটি নতুন কিছু ছিল না। মাইকেল দেশে ফিরে এসে তার পূর্বসূরীদের দেখানো এই ছন্দেই লিখতে শুরু করেন। পশ্চিমের ‘ব্ল্যাংক ভার্স’কে কপি করে পদান্তের অন্তানুপ্রাস তুলে দিয়ে নাম দেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ।

ইংরেজরা দশম শতকের দিকে কিছু ব্ল্যাংক ভার্সের কবিতা লেখেন। পরবর্তিতে গবেষকেরা এইসব পঙক্তির সন্ধান পেয়ে তো মহাখুশি। তারা ভেবেছিলেন ইংরেজরাই ব্ল্যাংক ভার্সের আবিস্কারক। কিন্তু কবিতার ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করে তারা জেনে ফেলেন ফরাসীরা তারও অনেক আগে থেকে প্রায়শই ব্ল্যাংক ভার্সে কবিতা লিখতেন। কিন্তু ফরাসীরা, এবং ইংরেজরাও, তখন ব্ল্যাংক ভার্সের কবিদের অমেধাবী কবি মনে করে বাতিল করে দিতেন। পনের শতকে এসে ইংরেজি সাহিত্যে ব্ল্যাংক ভার্স গ্রহনযোগ্যতা পায়। জন মিল্টন, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থরা লিখে ব্ল্যাংক ভার্সের একটি গ্রহনযোগ্যতা তৈরি করেন।

আসুন বোঝার চেষ্টা করি ব্ল্যাংক ভার্স আসলে কি জিনিস? তখনকার দিনে ইংরেজ কবিরা আইঅ্যামবিক প্যান্টামিটারে কবিতা লিখতেন। আইঅ্যামবিক প্যান্টামিটার হচ্ছে ছন্দের ধরণ বা কবিতার প্রকরণ। এই ছন্দে দুটি ধ্বনিতে একটি পর্ব হয় এবং পাঁচটি পর্বে একটি পঙক্তি হয়। এই ছন্দেই শেক্সপিয়ার তার সনেটগুলো রচনা করেন। ম্যাকবেথ এবং রোমিও জুলিয়েটে এসে আইঅ্যামবিক প্যান্টামিটার ঠিক রেখে পদান্তের মিলটা তুলে দেন। এই অমিলকরণের নামই হলো ব্ল্যাংক ভার্স। ছন্দ কিন্তু তুলে দেননি, শুধু অন্তমিল পরিহার করেছেন। যে কাজটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত মেঘনাদ বধ মহাকাব্যে করেছেন। তিনি আব্দুল হাকিম, আলাওল বা দৌলত কাজীদের ৮+৬ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত ছন্দটা নিয়েছেন আর ইংরেজি কবিতা থেকে ব্ল্যাংক ভার্স (অমিলকরণ) নিয়ে তৈরি করেছেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ।

এখন আসি সনেটে। পৃথিবীতে দুই ধরণের সনেট লেখা হয়। একটি পেট্রার্কান সনেট বা ইতালিয় সনেট। অন্যটি শেক্সপিয়েরিয়ান সনেট বা ইংলিশ সনেট। সব সনেটই আইঅ্যামবিক পেন্টামিটারে লেখা হয়। অর্থাৎ প্রতি লাইনে ১০টি (২+২+২+২+২) ধ্বনি থাকে, যাকে আমরা সিলেবল বলি। বাংলায় সিলেবল ভিত্তিক ছন্দ হচ্ছে স্বরবৃত্ত ছন্দ। পেট্রার্কান এবং শেক্সপিয়েরিয়ান সনেটের পার্থক্য ছন্দে না, পঙক্তি সংখ্যায় না, পার্থক্যটা হলো শুধু অন্তমিলে। শেক্সপিয়েরিয়ান সনেটের অন্তমিল-সূত্র হচ্ছে: কখকখ গঘগঘ ঙচঙচ ছছ। অর্থাৎ এক লাইন বাদ দিয়ে দিয়ে অন্তমিল, এভাবে বারো লাইন লেখার পর শেষ দুই লাইনে মিল। পেট্রার্কান সনেটের অন্তমিল-সূত্র হচ্ছে: কখখক গঘঘগ ঙচছঙচছ। অর্থাৎ প্রথম লাইনের সাথে চতুর্থ লাইন এবং দ্বিতীয় লাইনের সাথে তৃতীয় লাইনের মিল। এভাবে দুই স্তবক। শেষ ছয় লাইনের মিলটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথম লাইনের সাথে চতুর্থ লাইন, দ্বিতীয় লাইনের সাথে পঞ্চম লাইন এবং তৃতীয় লাইনের সাথে ষষ্ঠ লাইনের মিল।
দুই ধরণের সনেটই ১৪ লাইনে সীমিত এবং অন্তমিল ছাড়া কোনো সনেট লেখা হয় না।

সনেট এবং হাইকু বিদেশি কবিতার ফর্ম। সারা পৃথিবীর মানুষ এই দুটি ফর্ম সম্পর্কে জানে এবং বেশ জনপ্রিয় ফর্ম এগুলো। এসব ফর্মে যদি লিখতেই হয় তাহলে মূল কবিতার কাছাকাছি থেকে লিখতে পারাই সঙ্গত। মূল ফর্মকে ভেঙে যদি নতুন কিছু করতেই হয় তাহলে নতুন নামে করা যেতে পারে।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত যদি মূল সনেটের ছন্দে (স্বরবৃত্তে) সনেট লিখতেন তাহলে হয়ত এখন সবাই স্বরবৃত্তেই লিখত। পরবর্তিতে জীবনানন্দ দাশ, সুফি মোহাতার হোসেন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ প্রচুর সনেট লিখেছেন। তারা সকলেই অক্ষরবৃত্তে বা পয়ারে লিখেছেন। মাত্রা সংখ্যা বাড়িয়েছেন, ১৪ মাত্রায় না রেখে ১৮, ২২ বা ২৬ মাত্রায় লিখেছেন।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দে আমি নিজেও প্রচুর কবিতা লিখেছি, তা সত্বেও বলি, এটি ন্যাচারাল ছন্দ না। যে কারণে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতা মানুষ খুব সহজে মনে রাখতে পারে না। অক্ষরবৃত্তে কেউ যদি যুক্তাক্ষর বর্জন করে লেখেন, সেটি মাত্রাবৃত্ত হয়ে যায় সেইরকম কিছু অক্ষরবৃত্তের লাইন পপুলার হয়ে উঠেছে। যেমন মাইকেলের ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতার ‘সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে/ সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।’ লাইন দুটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে ৮/৬ মাত্রায় সাবলিলভাবে পড়া যায় বলে খুব সহজেই মনে গেঁথে যায়। অথচ ‘জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।’ এই লাইনে এসে অক্ষরবৃত্তে ৮/৬ মাত্রা ঠিক থাকলেও যেহেতু মাত্রাবৃত্তে শেষের পর্বটিতে ‘ভ্রান্তির’ যুক্তাক্ষরের কারণে এক মাত্রা বেশি আছে, বেশ বড়সড় একটি ধাক্কা লাগে। আমার অন্তত বহুবার হয়েছে এই লাইন পড়ার পরে কবিতাটি পড়ার স্বাভাবিক আগ্রহ আর থাকেনি। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের দূর্বলতা নিয়ে এমন অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়।

ব্ল্যাংক ভার্স এবং ফ্রি ভার্স কিন্তু এক জিনিস না। আজ ব্ল্যাংক ভার্স নিয়ে আলোচনা করলাম অন্যদিন ফ্রি ভার্স নিয়ে আলোচনা করবো।

ফোর্ট লডেরডেল। ফ্লোরিডা।
৯ জুলাই ২০২১।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD