২৫ জনের যৌথ পরিবার ( ১ম পর্ব)
ড গৌরী ভট্টাচার্য্য
ঠাকুরদা,ঠাকুরমা,নিঃস্বদিদিমা,বাবা,মা, মেজবাবু,মেজমা,পিশি,মাষ্টার কাকু, কাজের পিশী।
আমরা ৫ বোন,এক ভাই, মেজবাবুর ৪ মেয়ে,দুই ছেলে। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি কলেজ ছিল বলে বাড়িতে আরও থাকতো আত্মীয় স্বজনের ৪ ছেলে। দুই গাভী,বাছুর দেখভাল করার জন্য লোকও ছিল।বাড়িতে ১২ মাসে ১৮পার্বন লেগেই থাকতো।
অহরহ আত্মীয় স্বজন,বাবাকাকার বন্ধুবান্ধব,পাড়াপ্রতিবেশির আসাযাওয়ায় বাড়ি মুখর থাতো। কী আনন্দঘন পরিবেশ বাড়ীতে বিরাজ করতো ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা। এখন ছোট পরিবার সবাই আত্মকেন্দ্রিক।
সেইদিনগুলি আজকাল খুবই মিস করি। মনে হয় সেই দিনগুলি যদি আবারও ফিরে পেতাম। আনন্দ হতো। কথাবার্তায় বড়দের মধ্যে দেখেছি সবসময় সবার কত মান্যতা,শালীনতা, আথীতেয়তা, পূজা, ভক্তি,দান ধর্ম। আমার মা মেজমাকে হাসিমুখে কত পরিশ্রম করতে দেখেছি আজকালকার দিনে একেবারেই কল্পনাতীত।
আমার ঠাকুরদার বিশাল বড় দোতলা বাড়ি, সামনে ছোট উঠান,বাহিরদিকে বড় উঠান মাঠের মতো।
ঠাকুর ঘর,ঢেঁকিঘর,বিশাল রান্নাঘর, নিরামিষ রান্নাঘর, পিছনে গোয়ালঘর।
ঠাকুর ঘরের চারপাশে বহুরকম ফুলগাছ,তুলসীগাছ, বেলগাছ, লেবুগাছ। বাড়ির পূবদিকে শুপারী বাগিচা, উত্তর দিকের বাগিচায় প্রচুর আমগাছ,জামগাছ, কাঁঠালগাছ,চালতাগাছ,আরও কতরকম গাছ ছিল নাম মনে নেই।সেই বাগিচা থেকে কাজের পিসি শীতের দিনে শুকনো পাতা কুড়িয়ে ভিতরের উঠোনে স্তুপ করে রাখতো,কাজকর্ম সেরে আগুন ধরাতো হাত,পা সেঁকতো।
উঠোনের একপাশে শীতকালীন মাটির চুলা কাজের পিসি বানিয়ে রাখতো। সেই উঠোনে আাশেপাশের বাড়ীর অনেকেই খুশীখুশী মনে আসতো, চাটাই,মাদুর পেতে বসে যেতো,পারুল পিসিকে বলতো, খুবকড়া ঘনদুধ দিয়ে গরম চা দিতে।কাজের কোন ক্লান্তি পারুল পিসির মধ্যে ছিলনা।
চা, জলখাবার, পিঠা, মোয়ামুরকী আরও কতো কী নিজেই বানাতো,খই,মুড়ি,ভাজতো,খেজুরের রস জাল করতো।আমার মা, মেজমা সারাদিন ঘরের সবদিক খেয়াল রাখতেন।ঠাকুরদাঠাকুরমার সেবাযত্নকরা, রান্নাকরা,কী কী রান্না হবে,আজ অতিথি খাবে কিনা এসব নিয়ে ঠাকুরমার সাথে আলোচনা করে রান্নার আয়োজন করতেন। দিনভর রান্না,আর পরিবেশনা চলতো।
খাবার ঘরে সবাইকে পিড়ি পেতে কাঁসের থালা বাটি গ্লাসে পরিবেশন করা হতো। প্রথম পর্বে ছোটরা,তারপর বড়রা , সবার শেযে মা মেজমা,কাজের পিসি,। এতো এতো কাঁসের থালাবাসন জলের কলসী কাজের পিসি লেবু আার ছায় দিয়ে মেজে সোনালী করে ঠাকুরমাকে দেখাতো পরিস্কার হয়েছে কিনা।
এতো বেশী পরিস্কার দেখে আমরা সবাই হেসে বলতাম এবার পুরস্কার পাবে পারুল পিসি,কানের দুল পাবে,পূজোর সময় দামী শাড়ি পাবে।
বাড়ীর কাছাকাছি কালচাঁদ ঠাকুর বাড়ী, তাই ঠাকুর বাড়িতে এসে অনেক আত্মীয় স্বজন আমাদের বাড়িতে আসতেন। ঠাকুরমা বলতেন অতিথি দেবতূল্য দুপুরে তারা ঘরে যেমন রান্না হবে তেমনই খেয়ে যাবেন। আমার মা, মেজমা একটুও বিরক্ত হতে দেখিনি।যৌথ পরিবারে অতিথিশালার মতো দোতলা ব্যবহৃত হত।
মা, মেজমা কখন যে খেতো,কখন স্নান করতো আমরা ছোটরা বুঝতেই পারিনি।ঘরোয়া কাজে হাত লাগানো আমাদের নিষেধ ছিল। কৌতূহল করে কখনো কখনো কিছু করতে গেলে ধমক দিয়ে বলতো যাও পড়ার ঘরে,নয়তো ঠাকুরদাকে বলে দেবো।
ঠাকুরদা বাড়ীর প্রধান, উনার যেমন আদর তেমন কড়া শাসন। উনার কথার উপর কেউ কথা বলতোনা, সব সিদ্ধান্ত তিনিই নিতেন,এবং সফল হতেন। বড়দের কথায় উত্তর করা,বড়দের কাজে হাত লাগানো আমাদের কখনোই চলতোনা। আমরা সবাই সেভাবেই অভ্যস্ত হয়ে বড়
হয়েছি।
আমাদের বাড়ির দক্ষিণদিকে বিশাল একটা পুকুর। ওটিকে পুরান পুকুর বলে সবাই। সেই পুকুর পারে জৈষ্ঠ্যঠাকুরদারা একটা স্কুল গড়ে দিয়েছিলেন,স্কুলের নাম ভট্টাচার্য্য প্রাইমারি স্কুল। শুনেছি প্রথমতঃ নাকি বাড়ির মেয়েদের জন্য স্কুলটা করা হয়েছিল, পরে গ্রামবাসীদের জানানো হল স্কুলটি সবার পড়ার জন্য, ছেলে মেয়ে গ্রামের সবাইকে পড়তেই হবে। গ্রামের মানুষ ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করতে দূরে পাঠাতে চায়তোনা।
তাই গ্রামের ভিতরেই আমাদের ‘ভট্টাচার্য্য প্রাইমারী স্কুল’ সবার পড়াশোনার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলো।
আমরাও সেই স্কুলে পঞ্চমশ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি।আমরা পণ্ডিত মশাইর কাছে সংস্কৃত পড়েছি আবার মৌলভীস্যারের কাছে বাংলা পড়েছি। আমার খুবই প্রিয় স্যার ছিলেন মৌলভী স্যার।উনি আমাকে গুরিয়া বলে ডাকতেন।পড়া না পারলে সবার হাতের তালুতে অনেক উঁচু করে বেত তুলে আলতো করে মারতেন,আর আামার শাস্তি ছিল একটি গান গাইতে হবে, সে যে গানই হোক।
উনি যে ভিন্ন ধর্মের মানুয বুঝতামনা,সেই ভেদাভেদ বা গোঁড়ামি কিছুই দেখতে পাইনি।উনি ছিলেন ছোটবড় সবার প্রিয় শিক্ষক। সব স্যারকে ভয় পেতাম, কিন্তু আমরা কেউ মৌলভী স্যারকে ভয় পেতামনা। উনি অত্যন্ত বিনয়ী এবং স্নেহপরায়ণ মানুষ ছিলেন। আজকাল আমরা এমন মানুষ কল্পনাও করতে পারিনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা উনি খুব সুন্দর করে পড়াতেন। গল্প,সাহিত্য সবই খুব সুন্দর পড়াতেন।
মামারবাড়ীর দাদু আসলেই ইংলিশ গ্রামার পড়া ধরতেন,আমাদের তখন গ্রামার পড়ার হিরিক লেগে যেতো।দাদু ব্রিটিশ আমলের মেধাবী ছাত্র ছিলেন, এই গল্প বহুবার শুনেছি। উনি আসলেই গানের আসর,পড়া ধরার পর্ব চলতো। আমাদের জিজ্ঞেস করতেন,’আমি যাই, সে যায়, সে বাড়ি যায়’, ইংরেজিতে বলতে। ‘সে যায়’ ইংরেজিতে আটকানো ছিল উনার আসল উদ্দেশ্য, আমরা আগেভাগেই ঠিক করে রাখতাম,সঠিক করে বলার জন্য, প্রতিবার একই প্রশ্ন। মাষ্টারকাকুকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল,” ইংরেজিতে বল। মাষ্টার কাকু বলতে দেরী করলেই জিজ্ঞেস করতো কলেজে উঠবে? তুমি নাকি মাষ্টারী কর,অথচ গ্রামার, টেন্স ইংরেজির কিছুই তো শেখনি,মাষ্টার কাকু মাথা নীচু করে একটু সময় নিয়ে সঠিক উত্তর দিতেন।দাদু বলতেন,ঠিক আছে। উত্তর দিতে এতক্ষণ লাগে কেন?যাও এখন।তবে বিকেলে সবাই একটা করে রবীন্দ্রনাথের গান,আবৃত্তি যে যা পার তৈরি হয়ে থেকো।
প্রত্যেককেই করতে হবে।আমার পিসি দাদূ আসলে গ্রামার রিভাইজ করে রাখতো, সবাই গানও ঠিক করে রাখতাম, পিসি সব সঠিক উত্তর দিতে পারতো। তাই পিসিকে দাদু বেশী স্নেহ করতেন। ভরসা করতেন পিসিকে, ডেকে বলতেন বিকেলে সব ঠিকমতো আয়োজন করে রাখতে।
দাদু পিতলের হুকা লম্বা নল লাগানো পাইপ টানতে টানতে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসতেন। একে একে সবার গান, আবৃত্তি,চোখ বন্ধকরে শুনতেন, ভুল হলেই থামিয়ে দিয়ে নাম ধরে বলতেন,আবার শুরু কর,। সেই আসরে পাড়ার সবাই এসে অংশ গ্রহণ করতো। দাদু মাঝে মাঝে পিছন ফিরে ডেকে বলতেন কে আছ, কল্কিতে একটু আগুন দিয়ে যাও,এই বলে গুড্ গুড্, গুড্ গুড্ করে হুকার পাইপ টানতেন।
(চলবে)
Leave a Reply