সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চার দশক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি একাধারে কবি, কথা-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসাবে অসংখ্য স্মরণীয় রচনা উপহার দিয়েছেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ- পরবর্তী সময়ের অন্যতম প্রধান কবি। আজ ৭ সেপ্টেম্বর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ৮৭তম জন্মবার্ষিকী। তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৫৩ সাল থেকে কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’ ও ১৯৬৬ সালে প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হল- আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, যুগলবন্দী (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), হঠাৎ নীরার জন্য, রাত্রির রঁদেভূ, অর্ধেক জীবন, অরণ্যের দিনরাত্রি, প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম মনের মানুষ ইত্যাদি। শিশুসাহিত্যে তিনি ‘কাকাবাবু-সন্তু’ নামে জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজের রচয়িতা। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি ভারতের জাতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠান সাহিত্য অকাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর আকাদেমির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার মাইজপাড়া গ্রামে ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। চার বছর বয়সে তিনি পরিবারের সাথে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান, সেখানেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। পড়াশোনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ব্যাংকের পিয়নের চেয়েও স্কুল মাস্টারের বেতন ছিল কম। সুনীলের মা তাই কখনোই চাননি ছেলে শিক্ষকতা করুক। পড়াশোনা শেষ করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিছুদিন অফিসে চাকুরি করেছেন। তারপর থেকে বাকি জীবন কাটিয়েছেন সাংবাদিকতায়। তবে আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান মি. পলেন কলকাতায় এলে সুনীলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। সেই সূত্রে তিনি মার্কিন মুলুকে যান ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে। পড়াশোনা শেষে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপগ্রন্থাগারিক হিসাবে কিছুদিন কাজ করেন।
সুনীলের পিতা তাঁকে টেনিসনের একটা কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রতিদিন এখান থেকে দুটি করে কবিতা অনুবাদ করবে।’ এটা করা হয়েছিল এ জন্য যে, তিনি যেন দুপুরে বাইরে যেতে না পারেন। তিনি তা-ই করতেন। বন্ধুরা যখন সিনেমা দেখতো, বিড়ি ফুঁকতো, সুনীল তখন পিতৃ-আজ্ঞা শিরোধার্য করে দুপুরে কবিতা অনুবাদ করতেন। অনুবাদ একঘেঁয়ে হয়ে উঠলে তিনি নিজেই লিখতে শুরু করেন। ছেলেবেলার প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে লেখা কবিতাটি তিনি দেশ পত্রিকায় পাঠালে তা ছাপা হয়। এভাবেই সুনীল ধীরে ধীরে লেখালিখিতে জড়িয়ে পড়েন। নীললোহিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম। নীললোহিতের মাধ্যমে সুনীল নিজের একটি পৃথক সত্তা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। নীললোহিতের সব কাহিনিতেই নীললোহিতই কেন্দ্রীয় চরিত্র। সে নিজেই বলে চলে আত্মকথার ভঙ্গিতে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বেশ কিছু গল্প-উপন্যাসের কাহিনি চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। এর মধ্যে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত অরণ্যের দিনরাত্রি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কাকাবাবু চরিত্রের চারটি কাহিনি যেমন- সবুজ দ্বীপের রাজা, কাকাবাবু হেরে গেলেন, মিশর রহস্য এবং ইয়েতি অভিযান চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। হঠাৎ নীরার জন্য তাঁর চিত্রনাট্যে নির্মিত আরেকটি ছবি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর হৃদ্যন্ত্রজনিত অসুস্থতার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে ২০০৩ সালের ৪ এপ্রিল কলকাতার ‘গণদর্পণ’কে তিনি সস্ত্রীক মরণোত্তর দেহদান করে যান। কিন্তু সুনীলের একমাত্র পুত্রসন্তান সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ইচ্ছেতে তাঁর মরদেহ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ব্যবস্থাপনায় ২৫ অক্টোবর দাহ করা হয়। সুনীল ২০০২ সালে কলকাতা শহরের শেরিফ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ ও ১৯৮৯ সালে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৮৫ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে তিনি ভূষিত হন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তিন শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো-পূর্ব-পশ্চিম, সেই সময়, প্রথম আলো, একা এবং কয়েকজন, ছবির দেশে কবিতার দেশে, অরণ্যের দিনরাত্রি, সরল সত্য, কালো রাস্তা সাদা বাড়ি, কবি ও নর্তকী, স্বর্গের নিচে মানুষ, সময়ের স্রোতে, স্বপ্ন লজ্জাহীন, প্রকাশ্য দিবালোকে, দর্পনে কার মুখ, আকাশ দস্যু, অমৃতের পুত্রকন্যা, জোছনাকুমারী, ভালবাসার দুঃখ, জনারণ্যে একজন, বুকের মধ্যে আগুন, অগ্নিপুত্র, সোনালি দুঃখ, অচেনা মানুষ, বৃত্তের বাইরে, মহাপৃথিবী, উত্তরাধিকা, মায়া কাননের ফুল, অন্য জীবনের স্বাদ, প্রবাসী পাখি, বুকের পাথর, উদাসী রাজকুমার, অনসূয়ার প্রেম, মধ্যরাতের মানুষ, অনির্বান আগুন, দরোজার আড়ালে, বেঁচে থাকার নেশা, কল্পনার নায়ক, সোনালী দিন, প্রথম প্রণয়, আঁধার রাতের অতিথি, ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ, সময়ের স্রোতে, সময় অসময়, বসন্ত দিনের খেলা, সুন্দরের মন খারাপ, সুন্দর রহস্যময়, আমার স্বপ্ন, আমি কিরকম ভাবে বেঁচে আছি, ভোরবেলার উপহার, হঠাৎ নীরার জন্য, প্রাণের প্রহরী, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজী, ছবির দেশে কবিতার দেশে প্রভৃতি।
©️ আহমেদ জহুর
কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
.
Leave a Reply