মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৩৩ পূর্বাহ্ন

কবি মিনার মনসুরের কবিতার পথরেখায় – কবি ফারুক মাহমুদ

কবি মিনার মনসুরের কবিতার পথরেখায় – কবি ফারুক মাহমুদ

কবি মিনার মনসুরের কবিতার পথরেখায় - কবি ফারুক মাহমুদ

মিনার মনসুরের কবিতার পথরেখায় অনেক নির্মিতি আছে, যেখানে নানা-রং ছায়া, নানা বর্ণের আলো হেসে আছে। দেশ, দেশের মানুষ, মানবের চিরঅধিকারের কথা আছে।

সে-থাকা কবিতার উচ্চারণে, বিচিত্র লেখায়। বঙ্গবন্ধুকে উপলব্ধি করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন, বুঝেছেন― বাঙালির নয়নতারা এই নেতা কী গুণে হয়ে উঠেছেন সব শ্রেষ্ঠদের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। পড়ুন পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত আমার ‘নির্বাচিত কবিতা’ নিয়ে কবি ফারুক মাহমুদের আলোচনা।

আগুনপাখির গান
ফারুক মাহমুদ

জানা এবং জানানোর মধ্যস্থানে ফারাক কতটুকু? অনতিক্রম্য? যেকোনো শিল্পের প্রয়াস হচ্ছে এই ফারাক উজিয়ে আসা। জানা এবং জানানোর মিশেলেই তৈরি হয় শিল্পসরণি। কত বাঁক! কত ঘোর! ঘুরে ফিরে আসা, সে-ও তো শিল্পের স্বভাব।


এমন বিবেচনায়, যদি কবিতার কথায় আসি, বলা যাবে, কবি যা জেনেছেন, তা-ই জানাচ্ছেন তার রচনায়। এখানে ‘জানা’ শব্দটি শুধু পাঠলব্ধ বা চাক্ষুষতার অর্জন নয়, বিস্তারিত অর্থে কবির মনে চোখ-মেলা ভাবনা ও অনুভাবনাও হতে পারে, হয়ও।

কখনো, কবি পৌঁছে যান বোধের নিশ্চিত কোনো আশ্রয়ে। এখান থেকে শুরু হতে পারে কবিতাসৃজনের শব্দযাত্রা? কিন্তু, তখনো, মনে উঁকি দিতে পারে সংশয়ের ছোট-বড় ঢেউ? এর মধ্য-থেকে অন্বেষণের নতুন আকাঙ্ক্ষা চলে এলে, বলা যাবে- এটাও শিল্পস্বভাব। শুরু হয় নতুন করে খোঁজা। কেন্দ্র স্থির রেখে বৃত্তের আবর্তনের মতো শুধু উত্তর খুঁজতে খুঁজতে পূর্ণতার কাছে চলে যাওয়া। এখানে দ্বন্দ্বও আছে। পূর্ণ আর অপূর্ণের দ্বন্দ্ব। প্রশ্নের পেছনে প্রশ্ন। উত্তর, আরো উত্তর। সিন্ধান্তে পৌঁছালে আর প্রশ্ন থাকে না, স্থবিরতা নেমে আসে। কবিতার স্থবিরতা নেই।

উন্মোচন-প্রয়াসে কবির মনোজগৎ আলোড়িত হয়, আলোকিতও। চিরকাল, অন্তত জেগে থাকা কবিরা এরকমই ভাবতে চেয়েছেন। মিনার মনসুরকে আমরা জেগে থাকা কবিদের দলভুক্ত করতে পারি।


সম্প্রতি মিনার মনসুরের ‘নির্বাচিত কবিতা’ পাঠ করেছি। এটি উল্লিখিত গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণ। প্রথম প্রকাশ ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে।

সেই বছরের ডিসেম্বরে পাঠকের হাতে আসে গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ। তৃতীর মুদ্রণ হয় পরের বছরই, অর্থাৎ ২০১৭ সালে। ২০১৬ থেকে ২০২০- চার বছরের মধ্যে একটি কবিতার বইয়ের চারটি সংস্করণ! নিশ্চয় খুব আনন্দের বিষয়। এমনিতে প্রচলিত আছে, কবিতার বই তেমন বিক্রি হয় না, পাঠক কম। কিন্তু মিনার মনসুরের ‘নির্বাচিত কবিতার’ কপালে অপবাদের সেই চিহ্ন লাগেনি।

বলার অপেক্ষা রাখে না, কবিতার এই বইটি যথেষ্ট পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। এমন আনন্দসংবাদেও কবি কিন্তু তুষ্টি লাভ করেননি। তৃতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণের ভূমিকার একাংশে মিনার মনসুর লিখেছেন― ‘নির্বাচিত’ নাম ধারণ করে যে দেড়শতাধিক কবিতা এ-গ্রন্থে সগর্বে ঠাঁই করে নিয়েছে তা আরেকবার নাড়াচাড়া করতে গিয়ে মনটা বিষাদে ছেয়ে যায়। উপশমহীন গভীর এক অতৃপ্তির ফাঁস চেপে বসে অস্তিত্বে।


‘অতৃপ্তি’ হচ্ছে সৃজনশীল মানুষের পাথেয়। নিজের কাজে নিজে মুগ্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমনটি হলে তা হবে সীমাবদ্ধতার আবর্তন, স্থবিরতার অন্ধকার। মিনার মনসুর আত্মতৃপ্তির আচ্ছন্নতা থেকে বেরিয়ে জাত শিল্পীর মতোই বলেছেন, ‘মনে হয় সব ছুড়ে ফেলে দিই। আবার নতুন করে শুরু করি।’


প্রবহমান কবিদের লেখা কবিতার সংখ্যাটা উঁচু হয়। এর ব্যতিক্রমও আছে। যেমন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০); বেঁচে থাকা ছিল ঊনষাট বছর, সাকুল্যে সাতটি কাব্য। কবিতার সংখ্যা তিনশ’রও কম। অকালপ্রয়াত কবি হলে কবিতার সংখ্যা কম হওয়াই স্বাভাবিক। যেমন আবুল হাসান (১৯৪৭-১৯৭৫), মাত্র ঊনত্রিশ বছরের জীবন, প্রকাশিত কাব্য তিনটি। অবশ্য প্রয়াণের পর তাঁর অগ্রন্থিত কবিতার একটি সংকলন বেরিয়েছে। সংখ্যা নয়, বিচার্য হচ্ছে কবিতার সৌন্দর্য।


সাধারণত প্রায় প্রত্যেক কবির ভিন্ন-ভিন্ন কবিতার বইয়ে কবিতার আলাদা-আলাদা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। আবার এমনটি না-ও হতে পারে। বৈশিষ্ট্যের প্রবহমানতা থেকে যায়। যদি রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আসি, দেখি বৈচিত্র্যের সমারোহ। বিষয়, ভাবনা, দর্শন, আঙ্গিক, কোথায় নেই নতুন উদ্ভাবন!

আবার, এটাও তো সত্য, কবিতার দীর্ঘ পথচলায় রবীন্দ্রনাথের কোনো অর্থহীন দ্রুততা বা অকারণ শ্লথবদ্ধতা নেই। অনেক কবিতাকুসুম, বর্ণে গন্ধে গরিমায় ভিন্ন, কিন্তু গাঁথা হয়েছে একটি মালা। ‘কবি-কাহিনী’ (১৮৭৮) দিয়ে শুরু করে, যেতে-যেতে ‘জন্মদিনে’ (১৯৪১) পর্যন্ত পঞ্চাশটি কাব্যই আলাদা বৈশিষ্ট্যময়। এমনকি কবির প্রয়াণের পর প্রকাশিত পাঁচটি গ্রন্থেও বৈশিষ্ট্য এবং বৈচিত্র্যের কোনো অনুপস্থিতি নেই। অথচ, কবিতামণ্ডলীর মধ্যে একটি অন্তর্গত সুরালোক পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে।


প্রত্যেক ভাষার স্মরণীয় কবির কবিতা-সরণির দৃশ্যটি এমনটাই। যেতে-যেতে অনেক বাঁক, কিন্তু আদি-অন্তে একটা বৈশিষ্ট্যেরই বিস্তৃতি-অভিন্ন ধারাপ্রবাহ।


কবিতাভ্রমণের বৈচিত্র্য কবির কাব্য আলাদা আলাদা পাঠ করলে পাওয়া যায়। কিন্তু এর একটি বিকল্প উপায় চালু রয়েছে। কবির সব কাব্য থেকে কিছু কবিতার সংকলন করা। আমাদের দেশেও এমন চল আছে। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘বাছাই কবিতা’, ‘প্রিয় কবিতা’―বিচিত্র নাম। এ-ধরনের সংকলনে কবি নিজেই কবিতা নির্বাচন করেন। মিনার মনসুরের ‘নির্বাচিত কবিতা’ এমন বৈশিষ্ট্যেরই গ্রন্থ। এতে কবির প্রথম কাব্য ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্র’ (১৯৮৩) থেকে শুরু করে ‘আমার আজব ঘোড়া’ (২০১৯) পর্যন্ত নয়টি কাব্য থেকে কবিতা নেওয়া হয়েছে। আরো আছে অগ্রন্থিত কয়েকটি কবিতা। গ্রন্থটির বর্তমান সংস্করণে প্রচ্ছদ বদলেছে। ‘আমার আজব ঘোড়া’র কবিতা, অগ্রন্থিত কবিতা, নতুন প্রচ্ছদ- এ-সব মিলিয়ে, পাঠে এবং দেখায় পাঠক বাড়তি কিছু পাবেন।


‘সব লেখা আত্মজীবনীর অংশ’, এ-কালের এক কবি এমনটাই বলেছেন। অস্বীকার করছি না। তবে আরো কিছু যোগ করার তাগিদ অনুভব করছি। লেখায় আত্মসময় কি অগ্রাহ্য করা যাবে? সংলগ্ন অতীত? অদূর বা দূরের সময়-পরিধি? ‘আসন্ন’ কালও তো আসতে পারে লেখার অনুষঙ্গ হয়ে। উপলব্ধি, জিজ্ঞাসা, অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যেতে পারে সময়ের পূর্ণ পরিধি। এমন বিশ্বাসের আলোয় দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে মিনার মনসুরের ‘নির্বাচিত কবিতা’র কবিতাগুলো। বিষয়ের বিভিন্নতা, সামষ্টিক সুরালোকটি উপলব্ধি করার চেষ্টাও থাকবে।


গত শতকের সত্তর দশক। বাঙালির ইতিহাসের ঘটনাবহুল কালপরিধি। বহু যুগের আকাঙ্ক্ষা ছিল, ত্যাগ ছিল। শাসক বদলেছে, মানচিত্র বদলেছে, এই জনপদের মানুষ কখনো দেখেনি ‘স্বাধীনতা’র মহার্ঘ্য আলো। একাত্তরে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র হলো। কীট নেই, কাঁটা নেই। চোখ ভরে হাসে স্বপ্ন, আরো স্বপ্ন।


কপালপোড়া জাতি(?), বাঙালির স্বপ্নস্রোত শ্বাসরুদ্ধ হতে বেশি সময় লাগেনি। মাত্র সাড়ে তিন বছর। মানব-ইতিহাসে লেখা হলো একটি বিষাদ-অধ্যায়। বাঙালির মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মর্মান্তিকভাবে নিহত হলেন।


ষড়যন্ত্র, মুখোশ, সত্য মুছে ফেলার কূটাচার, নখে-দাঁতে হিংস্রতা― সব মিলিয়ে জটিল অন্ধকার। শোকের বিকট ছায়া। শব্দহীন রোদনের দাহ। মনোভূমি বিবর্ণ-বিরান। দমবদ্ধ সময় তাড়ানো জরুরি। শুরু হলো ‘দ্বার ছুটায়ে বাধা টুটায়ে’ পথ খোঁজার পালা। ঘুরে-দাঁড়ানো মানুষ দলবদ্ধ হলো।


তখন আশ্চর্য এক সময়! প্রতিবাদ। প্রতিরোধ। বধির বেদনাগুলো হতে হতে হয়ে উঠছে বারুদের স্তূপ।
গত শতকের মধ্য-সত্তরে এমনই ছিল বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি। শেকল ভাঙার শব্দ। ইতিহাসকে ঘরে ফেরাতে হবে। বিধিনিষেধের দেওয়াল। এর মধ্যেও থেমে নেই সভা-সমাবেশ, মিছিলের মিলিত কোরাস। রক্ত ঝরছে, লাশ পড়ছে। সেই উত্তাল, অস্থির, টালমাটাল সময়ে বাংলা কবিতাঙ্গনে মিনার মনসুরের উত্থান।


ওই-যে বলা হয়ে থাকে, সময়ের ছায়াপাতে পুরুষ্টু হয় শিল্পের সমূহ শরীর। মিনার মনসুরের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটবে কেন! চোখ-কান বন্ধ করে, শুধু মনের, কল্পনার রং ঢেলে সময়চিত্র আঁকা যায় না। মিনার মনসুর স্বকাল ধারণ-করা কবি। তাঁর প্রথম কাব্য ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’; এই নামের মধ্যেই নিহিত তাঁর কাব্যযাত্রার প্রারম্ভিক পর্যায়ের সময়চিত্র। সত্যি, তখন মানচিত্র অবরুদ্ধই ছিল। এই গ্রন্থের নাম-কবিতাটির (‘নির্বাচিত কবিতা’য় যুক্ত) অংশবিশেষ পাঠ করা যেতে পারে।

‘আমি সেই হতভাগ্য পা-চাটা কুকুর!/ আমি সেই অথর্ব মানব!/ প্রিয় মানুষের রক্তমাখা এই হাতে/ দ্বিধাহীন পানাহারে রত;/ নিরুদ্বেগ ঘুমে/ অচেতন কাটাই প্রহর;/ গণিকার উষ্ণ আলিঙ্গনে/ খুঁজি নির্ভরতা। / শতাব্দীর ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডে আমিই ঘাতক― / আমি সেই লোলুপ দর্শক। অবরুদ্ধ এই মানচিত্রে― / নিয়ত যেখানে― / নারী-হত্যা শিশু-হত্যা চলে/ বৃক্ষ-হত্যা পাখি-হত্যা চলে/ গবাদিপশুর রক্তে ভাসে/ ঐশ্বরিক স্বর্গের জাহাজ; আমি সেই রক্তপায়ী পাষণ্ড নাবিক― / অনকূল হাওয়ায় পাল তুলে রাখা/ শাশ্বত ব্রুটাস।’


উদ্ধৃত কবিতাসংশে পাওয়া যায় সময়ের একটি উৎকট চিত্র। কবি খেদোক্তি করছেন, বলেছেন গ্লানির এঁদো পাঁকে ডুবে থাকা ধূসর ভীরুতার কথা। ‘শাশ্বত ব্রুটাস’ শব্দ দুটি সামান্য শব্দবন্ধ নয়, এর মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে আছে অতীতাশ্রয়ী একটি গল্প। জুলিয়াস সিজার ছিলেন প্রাচীন রোমের একজন রাষ্ট্রনায়ক। তার বিশ্বাসভাজন সহচর মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস। জুলিয়াস সিজারকে হত্যার যে ষড়যন্ত্র হয়, এর নাটের গুরু ছিল ব্রুটাস। শুধু তা-ই নয়, সিজারের নির্মম হত্যাকাণ্ডে ব্রুটাস উৎকট উল্লাসে অংশ নেয়।

আক্রান্ত হওয়ার পর বীরত্বের সঙ্গে তা মোকাবিলা করছিলেন জুলিয়াস। কিন্তু যখন দেখলেন ব্রুটাস তাকে উপর্যুপরি আঘাত করছে, এমন দৃশ্য সহ্য হয়নি জুলিয়াস সিজারের, রণে ভঙ্গ দিলেন। রোমের ঐতিহ্যবাহী রাজকীয় লম্বা পোশাক ‘টোকা’র আড়ালে মুখ ঢেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন। গভীর সমুদ্রের হঠাৎ শান্ত হওয়ার মতো শুধু উচ্চারণ করলেন, ‘ও তুমিও ব্রুটাস!’ মিনার মনসুর, পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে এমন অনেক ‘ব্রুটাস’কে দেখেছেন। শব্দের দীর্ঘশ্বাসে তিনি বিশ্বাসহন্তাদের কদর্য ঘুটঘুটে মুখচ্ছায়া এঁকেছেন।


এই লেখার পূর্বাংশে আমরা উল্লেখ করেছিলাম, আত্মকাল তো বটেই, কবির মধ্যে ‘ফিরে তাকানো’ও থাকে। অদূর অতীতরেখার ঝিলিক দেখা যায় বর্তমানের ছায়ায়। পরম্পরা সব নির্মাণের পটভূমি। পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক কূপমণ্ডূকতা কবিকে দাঁড় করিয়ে দেয় নানা জিজ্ঞাসার ভেতর। সংলগ্ন অতীতের উজ্জ্বল অংশগুলো মনে এসে যায়। তিনি লিখেছেন, ‘বায়ান্নর রাজপথ থেকে সালাম-বরকত যদি/ রক্তমাখা খামে চিঠি লেখে― / যদি ব্যাকুল জানতে চায় : / আমাদের রক্তছাপা প্রিয় বর্ণমালা দিয়েছি তোমার হাতে,/ কোথায় রেখেছো তুমি ওই স্বর্ণোজ্জ্বল বর্ণমালা?/ বলো, আমি কী জবাব দেবো!’


লিখেছেন ছিষট্টির উত্তাল সময়ের একজন মনু মিয়ার কথা, নিজের রক্তভেজা সাম্যের পতাকা তুলে দিয়েছিলেন আমাদের হাতে। আরো লিখেছেন, একাত্তরের বীর যোদ্ধাদের কথা। এঁরা এনেছেন প্রিয় স্বাধীনতা। আবারো এসেছে পঁচাত্তরের কথা। উজ্জ্বল মানুষ, মানুষের অধিক সেইসব সাহস, নারী-পুরুষ-যুবকের কথা, যাঁদের রক্তে লেখা হয়েছে গভীর এক বিষাদ-অধ্যায়।
কবি নিজকে বার-বার প্রশ্নদীর্ণ করেছেন, ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায় মুছে ফেলার যে ঘৃণ্য চেষ্টা, রক্তমাখা অধ্যায় অবজ্ঞায় ঢেকে দেওয়ার যে আস্ফালন, এর প্রতিকার কী? এমন কঠিন, তির্যক প্রশ্নের জবাব কবি নিজে দিয়েছেন― ‘সাময়িক রুদ্ধ হয়― তবুও তো থামে না উত্থান।’


কোমল করে বলি ‘দ্রোহ’; এই-ই তো তারুণ্যের ধর্ম। উত্তেজনার তীব্র অভিব্যক্তি, আবেগ, স্বপ্ন স্থাপন, আবার বেদনা ও বিস্ময়ের মিশেলে দেখতে থাকা― স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে আকাঙ্ক্ষার সকল নির্মাণ। কিন্তু তারুণ্য তো কোনো নিদ্রাগ্রস্তের বুদবুদ নয়― আলো এলেই মিলিয়ে যাবে। কাঁটা, কাদা― পটভূমি যা-ই হোক, তারুণ্যের অহংকার দাঁড়িয়ে থাকি সামর্থ্যরে অবিচল পায়ে। এগিয়ে যায়। মিনার মনসুরের অনেক কবিতা এমনই শাশ্বতধারায় সিক্ত। কোনো কোনোটি প্রথম পাঠেই স্পর্শ করা যায়, কোনো কবিতায় তা দেখতে হয় অন্তরালের আলোয়।


কয়েকটি কবিতাংশ উদ্ধৃত করছি :

১.
‘অবসাদে নুয়ে পড়ে তবুও ভাঙে না।
ক্লান্তি জমে ভারী হয় বিষাদের নদী;
সাময়িক রুদ্ধ হয় উত্থানের গতি।’

২.
‘আমাদের সমবেত চিৎকারে আকাশ বিদীর্ণ করতে চাই
আমি রাজপথে সমস্বরে আমাদের না-বলা
দুঃখ ও ক্ষোভগুলো জানিয়ে দিতে চাই
আমি বিক্ষুব্ধ মিছিলে হাত-পা ছুড়ে কথা বলতে চাই।’

৩.
‘আমার অস্তিত্ব কাঁপে, কেঁপে ওঠে পরিপার্শ্ব― দুর্বৃত্ত সময়।
শিরায় শিরায় বেজে ওঠে আনন্দের বিস্ময়ের
আশ্চর্য বিদ্যুৎ। ইচ্ছে হয়, চিৎকার করে বলি―
হে মানুষ, তুমিই এ-পৃথিবীর মহত্তম কবিতা ও গান।
আমি আর কিছুই চাই না হতে― মানুষ, তুমিই
একমাত্র গন্তব্য আমার; বিপন্ন বিক্ষত ব্যর্থ
তবু মানুষ, তুমিই একমাত্র দ্রষ্টব্য আমার।’

এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। তিনটি উদ্ধৃতির মধ্যে একটি যোগরেখা টানলে লক্ষ করা যাবে, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস যেতে যেতে পরিণতি পেয়েছে বৃহত্তম উপলব্ধিতে, চিরায়ত আকাঙ্ক্ষার ধারাবাহিকতায়।


মিনার মনসুরের কলম যখন বলে, ‘অবরুদ্ধ এই মানচিত্রে /আমি সেই সর্বশেষ সংবাদপাঠক’―আমরা এর পটভূমির আভাসটা একটু কল্পনা করে নিতে পারি। আপসকামিতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার সংকীর্ণ পরিতৃপ্তির ভেতেরে যেমন নিঃসঙ্গ বোবা ক্রোধ জন্ম হতে পারে (হয়ই), দেখা দিতে পারে অন্তরালের আলোও। এ-হলো সংলগ্নতার ধর্ম। এর উত্থান ঘটে মানুষ, সমাজ থেকে। সত্য ও সুন্দরের উদঘাটনের ব্যাকুলতাই সাহসে উচ্চারণ করতে শেখায়, ‘সাময়িক রুদ্ধ হয়―তবুও তো থামে না উত্থান।’


বাংলাদেশ যার হৃদয়ে রক্ষিত―মিনার মনসুর, অনিবার্যভাবে তাঁর ভালোবাসার রঙিন রেখাগুলো আবর্তিত হবে এ দেশের স্বপ্নদ্রষ্টাকে ঘিরে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির স্বপ্ন দেখেই স্থির থাকেননি, এর বাস্তবায়নে যুক্ত করেছেন তাঁর সাহস, মেধা, প্রজ্ঞা এবং প্রশ্নাতীত দেশপ্রেম। বাংলাদেশ উদিত হওয়ার চার বছর যেতে না-যেতেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের রক্তাক্ত পথে সূত্রপাত ষড়যন্ত্রবাদের। এর প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, প্রতিকারের পথে বাংলাদেশের মানুষকে আবারও লড়াইয়ে নামতে হলো।


সে-ছিল বড় কঠিন সময়। সেই কঠিন সময়ের সাহসী লড়াকু মিনার মনসুর। মহান নেতার সামষ্টিক অর্জনের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। মিনার মনসুরের কবিতার পথরেখায় অনেক নির্মিতি আছে, যেখানে নানা-রং ছায়া, নানা বর্ণের আলো হেসে আছে। দেশ, দেশের মানুষ, মানবের চিরঅধিকারের কথা আছে। সে-থাকা কবিতার উচ্চারণে, বিচিত্র লেখায়। বঙ্গবন্ধুকে উপলব্ধি করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন, বুঝেছেন― বাঙালির নয়নতারা এই নেতা কী গুণে হয়ে উঠেছেন সব শ্রেষ্ঠদের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। শ্রদ্ধা, মুগ্ধতা, শ্রদ্ধা― নানা কৌণিক দেখা, এদের থেকে মিনার মনসুরের চেতনায় ফুটেছে অনেক কবিতাকুসুম। কত রং! কত গরিমা!


বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মিনার মনসুরের একটি শব্দচিত্র―
‘ঘাতক অন্ধকারে উন্মাতাল সাগরের বুক চিরে
ক্ষিপ্র ছুটে চলা জেলেদের মাঝিদের ভাঙা নায়ে
তুমি ছিলে মৃত্যুঞ্জয়ী অবিনাশী পাল―চেতনায়
সঞ্জীবনী ভাটিয়ালী গান। কর্মচ্যুত শ্রমিকের
বেদনায়-ব্যর্থতায় ক্ষয়ে আসা হাড়ে, প্রতীক্ষায়
নুয়ে আসা বিদীর্ণ পাজরে তুমি ছিলে সর্বজয়ী
বিশাল সাহস; ছিলে বিপ্লবের হিরন্ময় মহান সাধক।’

 

আলোচ্য গ্রন্থে বেশ কিছু কবিতায় প্রত্যক্ষে এবং পরোক্ষে বঙ্গবন্ধুর বিশালত্বের চিত্রকথা আছে।
কবিতায় প্রেমানুভূতি নেই―এমন কবি বিরল। আর কবি যদি হন বাংলাভাষী, তাহলে তো কথাই নেই। মিনার মনসুরের কবিতায় চিরপুরাতন, অথচ চিরনতুন সেই প্রেম বারবার এসেছে বিচিত্র আভরণে, আবরণেও অনেক রং। প্রেম যে শুধু দুটি মনের ব্যাকুল সীমাহীন অনুভূতি নয়, আরো গভীর বিস্ময়কর বিষয়, তা মিনার মনসুরের অনেক কবিতায় শনাক্ত করা যায়।
কবি যখন উচ্চারণ করেন, ‘তোমার যা কিছু― সে শুধু শব্দেই বাঁচে’ প্রচলনের বাইরে এসে অনুভূতির সূক্ষ্মতা সম্প্রসারিত হয়, ধারণ করে শব্দের নতুন ব্যঞ্জনা। শিল্পের দাবিটি স্পষ্ট। শব্দের সম্ভাবনা তৈরি করা এবং একে যথাযথ কাজে লাগানো লেখকের কাজ। কবিতায় শব্দের এমন সম্ভাবনা তৈরির কাজটি মিনার মনসুর সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছেন।
প্রায় সব ভাষার সহিত্যে ‘গদ্যকবিতা’ ‘টানাগদ্যের কবিতা’ প্রচলিত আছে। বাংলা ভাষায়ও অনেক কবি এমন ধারার কবিতা লিখে সফল হয়েছেন। মিনার মনসুরের অগ্রজ কোনো কোনো কবি গদ্যকবিতা লিখেছেন। তবে তাঁর সমকালে এধারার খুব বেশি কবি আমরা পাইনি। মিনার মনসুর গদ্যকবিতায় হাত পাকিয়েছেন। আলোচ্য গ্রন্থেও এমন ক’টি কবিতা আছে। স্বচ্ছন্দ প্রবহমানতার এসব কবিতা বাংলা কবিতার গীতিধর্মিতার বিপক্ষে দাঁড়ায়নি। বরং শব্দ যোজনা, ছন্দপ্রবাহে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
কবিতা নানা ধরনের। কোনো কবির ‘নির্বাচিত কবিতা’য় এমন নানা ধরনের কবিতা থাকাই স্বাভাবিক। মিনার মনসুরের আলোচ্য গ্রন্থে সেটাই হয়েছে। তাঁর কবিতার নানামুখিতা নিয়ে ন্যায্য আলোচনা করার পরিসর না-থাকায়, আমরা মুখ্য প্রবণতার দিকেই শুধু তাকাতে চেষ্টা করেছি।
উল্লেখিত এই গ্রন্থে পাঠকের মুখে মুখে ফেরে কবির এমন বেশ কিছু কবিতা রয়েছে। এটিও পাঠকের জন্য একটি সুবিধাসংবাদ।
ফারুক মাহমুদ : কবি, সাংবাদিক

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD