মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১০:২৭ পূর্বাহ্ন

মানিয়ে নেয়ার দায়িত্ব কি শুধুমাত্র নতুন বউদের?

মানিয়ে নেয়ার দায়িত্ব কি শুধুমাত্র নতুন বউদের?

মানিয়ে নেয়ার দায়িত্ব কি শুধুমাত্র নতুন বউদের?

মানিয়ে নেয়ার দায়িত্ব কি শুধুমাত্র নতুন বউদের?

শাশুড়ি এবং বউ দুজনই সংসারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। একটি সংসার আনন্দময়, শান্তিপূর্ণ ও সুখময় রাখার জন্য বউ শাশুড়ির সুসম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংসারে সুখ তখনই থাকে যখন বউ শাশুড়ির মাঝে সুসম্পর্ক থাকে। আর যদি সংসারের এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের মাঝে খারাপ সম্পর্ক থাকে, তাহলে সংসারের শান্তি শুধু কল্পনাতেই থেকে যাবে।

শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের ভেতর তথা স্বামীর পরিবারের ভেতর সহযোগীতামূলক মনোভাব না থাকা বর্তমান সময় সংসার ভাঙার অন্যতম কারণ। বউ-শাশুড়ির অমিলের কথা আমরা প্রায়শই শুনে থাকি। সাধারণত বউ-শাশুড়ির খারাপ সম্পর্ককেই আমরা পারিবারিক কলহ বলে থাকি। শাশুড়ির প্রতি বউয়ের এক বাক্স অভিযোগ, শাশুড়ি ভালো না, জ্বালাতন করে, দোষ খুঁজে বেড়ায়। বউয়ের প্রতি শাশুড়ির অভিযোগ – বউ অলস, অকর্মা, ব্যবহার ভাল নয় ইত্যাদি। এক কথায় এ যেন আমাদের সমাজের চিরচেনা চিত্র।

অথচ একটি সংসারকে সুখ-সমৃদ্ধ করার জন্য যেমনি প্রয়োজন শাশুড়ির সুনিপুণ পরিচালনা, তেমনি প্রয়োজন বউয়ের ইচ্ছে ও আন্তরিকতা। তাদের দু’জনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সংসারে আসতে পারে সুখ-শান্তি। তবে বউ-শাশুড়ির সংঘাত নিরসনে তাদের উভয়েরই মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। উভয়েরই পরস্পরকে ছাড় দেয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। সাধারণত বর্তমান সমাজে দেখা যায়, বউ শাশুড়ি দু’জনের কেউই বিন্দুমাত্র ত্যাগ স্বীকার করতে চান না। উভয়েই পূর্ণ ক্ষমতা খাটাতে চায়। যার ফল হিসেবে অশান্তির সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে উভয়ে যদি একে অপরকে ছাড় দেয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করে তাহলে অতি সহজেই এ সংকট থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।

ছেলের বউ তার শাশুড়িকে শ্রদ্ধা করবে। মনে করবে তার শাশুড়ি তার জন্য জননীতুল্য শ্রদ্ধার পাত্র। শ্বশুরকে মনে করবে পিতাতুল্য। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে তার আচরণ হবে হৃদ্যতাপূর্ণ। কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে জননীতুল্য বা পিতাতুল্য হলেও তাঁরা মাতাপিতা নন। তাই নিজের বাবা মা যে ভালোবাসা দিয়েছেন তা কখনই তাঁরা দিতে পারবেন না। নিজের বাবা মায়ের মত আপন কেউ হয় না। তাই নিজের বাবা মায়ের নিকট থেকে পাওয়া ভালোবাসা তাঁদের নিকট থেকে আশা করা যাবে না। এটাই চিরন্তন সত্য।

অপর দিকে নতুন অতিথি নববধূকে তার সংসারের সম্মান ও বাড়ির সৌন্দর্য হিসেবে ভাবতে হবে শাশুড়িকে। শাশুড়িকে অবশ্যই নজর রাখতে হবে যেন বাড়ির প্রত্যেক সদস্য নব বধূকে আপন করে নেয়, তার সঙ্গে আপন মানুষের মত আচরণ করে। একে অপরের প্রতি পূর্ণ সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে হবে। কিন্তু অনেক শাশুড়ি আছেন, বউয়ের ওপর অতি মাত্রায় বোঝা চাপিয়ে দেন। এহেন কাজকর্মও পুত্রবধুর কাঁধে চাপিয়ে দেন যা মূলত তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়।

বিয়ের আগে বউয়ের হয়ত খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস ছিল না। হয়ত রাত জাগার অভ্যাস ছিল, হয়ত কেউ চা কফি খেয়ে অভ্যস্ত সকালে, হয়ত কেউ রুটি, কেউ পরোটা, কেউ খিচুড়ি, কেউ ভর্তা-ভাত, আবার হয়ত কেউ সাতসকালেই মোরগ পোলাও, বিরিয়ানি খেয়ে অভ্যস্ত। আবার হয়ত কেউ এগুলোর একটিও সহ্য করতে পারে না।

শ্বশুর বাড়ি আর নতুন বউয়ের খাদ্যাভ্যাসে পার্থক্য থাকতে পারে। কেউ মাছ মাংসে ঝোল খায়, কেউ ভুনা করে – খাওয়া দাওয়া একটি বিশাল জায়গা দখল করে আমাদের জীবনে। সে অভ্যাস বদল করা এত সহজ নয়। বেশ সময় লেগে যায়। মনে রাখতে হবে বাড়ির বউ সংসারের স্থায়ী সদস্য। দুই দিনের অতিথি নন যে সব কিছুর অভ্যাস নতুন বউ পরিবর্তন করে এডজাস্ট করে নেবে। এডজাস্ট করার মানসিকতা সবারই থাকতে হবে।

আমাদের সমাজের অধিকাংশ বউ-শাশুড়ির মনমালিন্যের প্রকৃত কারণ হলো, বউ শাশুড়ি কেউই স্ব স্ব দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কে অবগত নন। বরং তারা একতরফাভাবে অধিকার ভোগ করতে চান। শাশুড়ির জন্য উচিত, বউকে নিজ সন্তানের ন্যায় আপন করে নেয়া। শাশুড়িকে ভাবতে হবে যে, বউ তার বাবা-মা, ভাই-বোন, একটি পরিবার যেখানে সে শৈশব থেকে বেড়ে উঠেছে, সেই পরিবারের মায়া ত্যাগ করে স্বামীর হাত ধরে চলে এসেছেন। স্বামীর সকল আত্মীয়-স্বজনকে সে আপন করে নিয়েছে। যার সাথে জীবনে কখনো দেখা সাক্ষাৎ নেই, পরিচয় নেই, এমন একজন অপরিচিত পুরুষ ও মহিলাকে নিজের অন্তরে সে বাবা-মার স্থান দিয়েছে। সেই অপরিচিত পুরুষকে সে বাবা বলে ডাকছে। আর অপরিচিত মহিলাকে মা বলে ডাকছে। সুতরাং তার সঙ্গে আদর-সোহাগের সাথে সুন্দর আচরণ করতে হবে। বউয়ের সাধারণ ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিতে হবে। মারাত্মক কোনো অন্যায় করলেও স্নেহ-মমতা দিয়ে তা শোধরাতে হবে। এতে মেজাজী বউও আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা চিত্তের হয়ে উঠবে।

পক্ষান্তরে খারাপ আচরণ করা হলে বউ বিগড়ে গিয়ে বাজে ব্যবহার করতে থাকবে। একপর্যায়ে তুমুল ঝগড়া-বিবাদ এমনকি সংসার ভাঙার পর্যায়ে চলে যেতে পারে। শাশুড়িকে মনে রাখতে হবে যে, জেদ দেখিয়ে খারাপ আচরণ করে যা করা যায় না, তা করা যায় মাতৃতূল্য মধুময় ব্যবহার দ্বারা।

শাশুড়িকে বুঝতে হবে ছেলের বউ হিসেবে একটি মেয়ে এনেছেন, অন্য বাড়ি থেকে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বউ আনেন নি..! তাই এই মেয়েটি সংসারের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন থাকবেনা এটাই স্বাভাবিক। ঘর-সংসার করা বউয়ের কাছে নতুন অভিজ্ঞতা, সে কখনো এ কাজ করে আসেনি। সবকিছু তার জন্য নতুন। সুতরাং ঘর গোছানো, রান্নাবান্না করা, অতিথিদের আদর-আপ্যায়ন করা মোটকথা সবকিছুতেই তার ভুলত্রুটি হতে পারে। এই ভুলত্রুটিগুলো শাশুড়িও হয়ত কোনো একসময় করেছিলেন। তার শ্বাশুড়িও তা মেনে নিয়েছিলেন। সুতরাং এখন তাকে তার পুত্রবধুর সাথে সে আরচরণটাই করতে হবে, যে আচরণ সে অন্যের পুত্রবধু থাকাবস্থায় তার শ্বাশুড়ির কাছ থেকে কামনা করেছিলেন।

শ্বাশুড়িকে মনে রাখতে হবে, তাঁর নিজের শরীরের যেমন খারাপ লাগা অনুভূতি হয়, তাঁর ছেলের বউয়েরও তেমনি অনুভূতি হয়, প্রয়োজন হয় একটু বিশ্রামের। সুতরাং তাকে বিশ্রামের সুযোগ দিতে হবে। ছেলের বউতো কৃতদাসী নয়। সুতরাং তার ওপর সংসারের সমস্ত কাজ চাপিয়ে দিয়ে শাশুড়ি তাঁর ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে শিমুল গাছের নিচে বসে হাওয়া খাবেন, ওই দিকে বউ বেচারীর কাজের চাপে প্রাণ প্রায় বিষিয়ে উঠবে, এটা অবশ্যই অমানবিক। শ্বাশুড়ি যখন যৌবনে ছিলেন তখন যেমন তার সমস্ত কামনা-বাসনা ও যাবতীয় সখ পূরণ করে নিয়েছিলেন, এখন তাঁর ছেলের বউয়ের পালা। বউও তার যাবতীয় কামনা বাসনা পূরণ করে নিতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই পুত্রবধু কোনো অন্যায় করে ফেললে তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতে হবে। পুত্রবধুর সঙ্গে স্নেহের কন্যা সুলভ আচরণ করবে। সামান্য ক্ষুদ্র কোনো বিষয়ে তাকে তিরস্কার করা উচিত নয়। শ্বাশুড়িকে বুঝতে হবে যে, তাঁর অবর্তমানে সংসারের দায়িত্ব ছেলের বউয়ের উপর বর্তাবে, নিজের মেয়ের উপর নয়।

অনেক সময় শ্বাশুড়িদের মনে অনিশ্চয়তা কাজ করে এটা ভেবে, আমার ছেলেটাকে এত দুঃখ-কষ্ট করে বড় করলাম। এখন নতুন একটা মেয়ে এসে সংসারে রাজত্ব করে, আমার ছেলেটাকে হাত ছাড়া করে ফেলবে, এটা কিভাবে মানা যায়? তখন শাশুড়িকেও চিন্তা করতে হবে যে, বাবা-মা মেয়েকে কষ্ট করে বড় করে অন্যের হাতে তুলে দেন। তিনিও তাঁর নিজের মেয়ের দিকে তাকাতে পারেন। এত কষ্ট করে মেয়েকে বড় করেছিলেন। লেখাপড়া করিয়েছেলেন। দিনশেষে অন্যের ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন। সেখানে আপনার মেয়ে রাণীর হালে থাকুক, এটাই আপনার কামনা। ঠিক আপনার ছেলের বউও কোন এক মায়ের সন্তান। তার মাও কামনা করে তার মেয়ে শ্বশুরবাড়ি আদরে সুখে থাকুক। নিজের মেয়ের বেলায় যেমনটি কামনা করা হয়, ছেলের বউয়ের ব্যাপারেও তেমনি আচরণ করতে হবে। তাহলেই সংসারে সুখ আসবে।

জাহিদ রহমান
ব্যারিস্টার এট ল
ইউকে

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD