মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:২৮ অপরাহ্ন

বার্ধক্যের শান্তির পথ

বার্ধক্যে শান্তির পথ
পরেশ কান্তি সাহা

পৃথিবীর প্রতিটা প্রাণীই শান্তি চায়। এমন কোন প্রাণী নেই যে কি-না শান্তি চায় না। মনে পড়ে মরমি বাউল সাধক শাহ আবদুল করিমের গানের একটা কলি – আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম…। কোথায় গেল সে দিন! ষাট-সত্তর দশকেওতো এমনটা ছিলোনা। ১০/১৫ জনের যৌথ পরিবার কতই না ভালো ছিলো। বিপদে-আপদে একে অপরের পাশে দাঁড়াতো। আর আজ! একক পরিবারেও এক বিন্দু শান্তি নেই। অথচ সেই শান্তির জন্য আমরা চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকি আকাশের দিকে।

সংসার জীবনটা বড়ই অদ্ভুত। চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই। আমাদের সমাজে দাম্পত্য জীবনে সবাই ছেলের আশা করে। বিশেষ করে প্রথম সন্তান যদি ছেলে হয়,তাহলে অনেক অনেক আশা ভরসার আলো দেখে। কারণ, আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করি। তারপর বংশ রক্ষারও একটা ব্যাপার আছে। যে কারণে ছেলে সন্তানের প্রত্যাশি হই। বুকভরা আশা থাকে- এই ছেলে মানুষের মতো মানুষ হবে। শিক্ষা- দীক্ষায় বড় হয়ে সে হবে মানুষের মতো মানুষ। আর যদি মেয়ে সন্তান হয়,তাহলে মনটা দুমড়ে-মুসড়ে যায়। সে তো আর এই সংসারে থাকবে না। বিয়ে দিলে চলে যাবে জামাইয়ের ঘরে। এমন কি পরপর যাদের তিন-চারটি মেয়ে সন্তান হয়েছে,ছেলে সন্তানের জন্য আবার তাদের ২য় বিয়ে করতেও দেখেছি। দায়ি করা হয় স্ত্রীকে। পরে দেখা গেছে প্রথম স্ত্রীর গর্ভে ৪ টি মেয়ে সন্তান হবার পর ওই গর্ভেই ৪ টি ছেলে সন্তান হয়েছে অথচ ২য় স্ত্রীর গর্ভে পরপর ২ টি মেয়ে সন্তান জন্ম নিয়েছে- ছেলে সন্তান হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ছেলে সন্তান বা মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়ার পেছনে দায়ী স্ত্রী নয়- পুরুষ। অথচ আমরা দায়ী করি স্ত্রীকে। কি এক নির্মম পরিহাস!

এক বুক আশা-ভরসার ডালি নিয়ে মা-বাবা প্রতিপালন করে তারা তাদের সন্তানকে। বিশেষ করে ছেলে লেখাপড়া শিখে বড় হবে,আয়-রোজগার করবে,বিয়ে দেবে,ঘরে বৌ-নাতি-নাতনী আসবে, ঘরটা হয়ে যাবে আলোয়-আলোকময়। ছেলে-বৌয়ের সেবাযত্নে ধন্য হবে জীবন। হায়রে মূর্খ! আপনারা ঠাকুরদা-ঠাকুমা হয়েছেন- অনেক কিছুই আপনাদের চাওয়া-পাওয়া আছে। কিন্তু সেখানে যে সব আশার মূলে গুড়ে বালি। সে কথাটা বোধ হয় জানা নেই। ছেলেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত যা করেছেন,তা ঠিকই করেছেন কিন্তুু বিয়ের পর যেটা আশা করেছেন,সেটা সম্পূর্ণ ভুল। ভুলের স্বর্গে বসবাস করছেন। যে ছেলেকে গর্ভে ধারণ করেছেন,লালন-পালন করে সুসন্তান হিসেবে গড়ে তুলেছেন, বিয়ের পর সে সন্তান আর আপনাদের নেই। যার হাতে সেই সন্তানকে তুলে দিয়েছেন অর্থাৎ বৌমার হাতে, এখন সে তার। হৃদয়ে এই সত্যটা ধারণ করতে না পারলে যন্ত্রণার দাবানলে জ্বলবেন,আর সেই যন্ত্রণা যে কতটা ভয়াবহ,তা একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না।

সন্তানের শিক্ষার মূল কেন্দ্র হলো পরিবার। আর সেই কেন্দ্রের প্রধান শিক্ষক হচ্ছেন মা। তাইতো নেপোলিয়ান বলেছেন- আমাকে ভালো মা দাও,আমি তোমাদের একটি ভালো জাতি উপহার দেবো। সেই মা যদি অপশিক্ষায় শিক্ষিত হয়,তাহলে সন্তান কি করে সুশিক্ষিত হবে?

কবি হেলাল হাফিজের কথাটা মনে পড়ে- কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার/কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার। প্রথমটা সঠিক হলেতো অবশ্যই ভালো থাকার কথা। আর যদি দ্বিতীয়টা সত্য হয়- তাহলে সোনার সংসার আগুনে জ্বলতে জ্বলতে অবশিষ্ট থাকে এককুলো ছাই।

আমরা আমাদের সন্তানদের ডাক্তার -ইঞ্জিনিয়ার তৈরী করার জন্য বড্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ি। মানুষ তৈরী করার জন্য চিন্তা করি না। সেই সন্তান বড় হয়ে কি হবে? সে কি মানুষ হবে,না অমানুষ হবে? কেন সে তার মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে না? ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মা-বাবাকে ঠাঁই নিতে দেখি বৃদ্ধাশ্রমে। আর গরীবদের দেখি ভাঙা বারান্দায় অথবা পথে – গাছতলায়। মানুষ তৈরী করার কথা বেমালুম ভুলে যাই। মানুষ তৈরী করতে হলে প্রয়োজন নৈতিকতা শিক্ষা। আর সেই শিক্ষা সহজে পাই আমরা আমাদের প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা থেকে। ছেলেকে আপনি যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। এর জন্য আপনি অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তুু সেই ছেলেকে বিয়ে দিয়ে যে বৌমা এনেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় – সে হয়তো কোন শিক্ষাই পায়নি। বিয়ের আগ পর্যন্ত তার জীবন কেটেছে লাটাই বিহীন ঘুড়ির মতো। বিয়ের পর সেই বৌমা এমন বেপরোয়া হয়ে ওঠে যে, সে কারোও কাছ থেকে কোন শিক্ষাই নেবে না- নিজের কর্তৃত্ব বজায় রেখে অশান্তির ধূম্রজালে জ্বালিয়ে তোলে পুরো সংসার। সে ক্ষেত্রে বৃদ্ধ-শ্বশুর শাশুড়ীতো দূরের কথা- তার স্বামী পর্যন্ত বিষধর সাপের ছোবলে বিষাক্ত হয়ে ওঠে।

এ প্রসঙ্গে বাসরঘরে বিড়াল মারার গল্পটা প্রত্যেকের জানা উচিত। যা শিক্ষা দেয়ার প্রথম দিন থেকেই দিতে হয়। তা না হলে সারা জীবনেও শিক্ষা দেওয়া যায় না। প্রতিটা পুরুষের ব্যক্তিত্য ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এটা জানা দরকার। আর তা না হলে মাঝিবিহীন নৌকার মতো নদীতে চলবে জীবন নৌকা।

পূর্বেই নীতিশিক্ষার জন্য ধর্মীয় শিক্ষার কথা বলেছি। অথচ আজ সমগ্র বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়- এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। এটা কি সত্যিকারে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা?

প্রত্যেকটা জিনিসেরই দুটো দিক থাকে- একটা ভালো, অপরটা মন্দ। যেমন- একটা কলম দিয়ে মানুষকে খুন করা যায়- আবার ঐ কলম দিয়ে একজন শিল্পী সুন্দর সুন্দর চিত্র অঙ্কন করতে পারেন। একজন কবি বা সাহিত্যক সুন্দর সুন্দর রচনা তৈরী করে পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে সহায়তা করেন। যে যেভাবে প্রয়োগ করবে তার ফলও ঘটবে অনুরূপ। সে জন্য প্রয়োজন নীতি শিক্ষা। এর কোন বিকল্প নেই।

এখন থেকে সব মা-বাবার প্রতি কিছু পরামর্শ- ছেলে বিয়ে দিতে হলে পরিবারটা যেন প্রায় সমানে সমান হয়। হাল চাষ করতে গেলে দুটো বলদ যদি সব দিক থেকে সমান না হয়,তাহলে চাষ করা যেমন যায় না,তেমনি ছেলে-মেয়ে বিয়ে দিতে হলে সব দিক দিয়ে সমানে সমানের কোন বিকল্প নেই।

ইদানিং আমরা হয়ে পড়েছি আত্মকেন্দ্রীক। নিজের ছাড়া অন্য কিছু বুঝি না। একটা রবীন্দ্র পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- মানুষ প্রথমবার জন্ম নেয় নিজের জন্য,পরে তাকে জন্ম নিতে হয় মানুষের জন্য। অথচ আজ হচ্ছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। মানুষের পরিচয় মুছে ফেলে পরিচয় হচ্ছে অমানুষে।

তার পরেও উভয় পরিবারের মধ্যে অন্তত শতকরা আশি ভাগ যদি সমান হয়, বিশেষ করে শিক্ষা এবং ধন-দৌলতে তাহলে মোটামুটি সামঞ্জস্য হয়। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মা-বাবাকে বলছি- ভুল করেও যেন নিন্ম অথাৎ গরীবের ঘরে ছেলে বিয়ে না দেন,- দিলে ছেলের বৌয়ের অফুরন্ত চাহিদা মেটাতে সর্বশান্ত হয়ে পথে দাঁড়াতে হবে।

ছেলে- মেয়ের বিয়ের দিন থেকে তাদেরকে ত্যাগ করতে শিখতে হবে। অর্থাৎ ছেলে হবে বৌমার আর মেয়ে হবে জামাইয়ের। ওদেরকে মানুষ করেছেন,এই কাজটুকু করতে পেরেছেন, এই সান্ত¡না নিয়েই থাকেন। এর বেশী কিছু চাইলে ভুল করবেন। আর ভুল করলে তার খেসারত দিতে হয়। তার জন্য প্রস্তুুত থাকা প্রয়োজন। জেনে রাখবেন- ছেলের বৌ হলো বৌমা,কখোনই নিজের মেয়ে নয়। মেয়ে ভাবলে বড্ড ভুল করবেন।

ছেলেকে বিয়ে দেয়ার আগে সম্ভব হলে তাদের জন্য আলাদা বাড়ি করে দেন। যতটা সম্ভব দূরে থাকে ততটাই মঙ্গল। তাদের জীবন তারা তাদের মতো করে গড়ে তুলুক। এতে সবাই ভালো থাকবে। মেয়েরা দূরে থাকে বলেই মা-বাবার প্রতি তাদের প্রগাঢ় ভালোবাসা,শ্রদ্ধা-ভক্তি অটল থাকে। অন্তত এক চাল বা ছাদের নিচে কখোনই একত্রে বসবাস করবেন না। যতটা না দেখা হবে,ততটাই মঙ্গল- সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হবে। অন্যথায় অন্ধ এবং বোবা হয়ে যেতে হবে। এছাড়া জীবনের শুরু থেকেই কিছু সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। যাতে বার্ধ্যক্যে বাকি জীবনটা কাটার জন্য কারও কাছে হাত পাততে না হয়।

জানি,এই কথাগুলো অনেকের কাছে ভালো লাগবে না। প্রশ্ন উঠবে- বৃদ্ধ বয়সে ছেলে-ছেলের- বৌ কাছে না থাকলে কে তাদের দেখাশোনা করবে? তাদের কাছে আমার পাল্টা প্রশ্ন- যাদের ছেলে কিংবা মেয়ে নেই,তাদেরকে কে দেখবে? তাই যদি সত্যি হয়,তাহলে এত্ত বড় এই পৃথিবী কি এতোই স্বার্থবাদী যে, একটি লোকও দেখার মতো থাকবে না! কেউ না থাকলে অন্তত একটা কুকুর পুষতে বলি। মৃত্যুতে অন্তত ও দুফোঁটা চোখের জল ফেলবে।

জীবনে প্রিয়জন,সংসার, পরিবার এবং দেশের জন্য সবাই কিছু না কিছু করে থাকে। বিনিময়ে কি পাওয়া গেল আর নাই পাওয়া গেল সে হিসেব করার কোন প্রয়োজন নেই। হিসেবের খাতা না হয় শূণ্যই থাক। সারাজীবন নিজের রক্ত দিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করার পরও কোন কৃতিত্ব নেই কিন্তুু ছোট্ট একটা ভুল হলেও তার ক্ষমা নেই- ওঠে তখন অগ্নিঝড়। হায়রে পৃথিবী!

শেষ জীবনে কি আর চাওয়া থাকতে পারে! জীবন যেমন সত্য, তেমনি মৃত্যু অবধারিত সত্য। এই সত্যের মাঝে জেগে থাকে কর্মময় জীবন বা স্মৃতি চিহ্নটুকু। বার্ধক্যে শান্তিতে মৃত্যুর চেয়ে আর কোন কিছুরই প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

৪ মে ২০২১ খ্রি.

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD