শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩২ পূর্বাহ্ন

প্রসঙ্গ বদরুল হায়দার এর কবিতা -জসীম মাহমুদ

প্রসঙ্গ বদরুল হায়দার এর কবিতা -জসীম মাহমুদ

প্রসঙ্গ বদরুল হায়দার এর কবিতা -জসীম মাহমুদ

“তুমি আমাতে অবাধ্য হও আমিও তোমাতে”

তিলমাত্র শব্দ হলে পরিকল্পনার বারোটা বেজে যাবে।
ঘুমিও না। আলো জ্বালিয়ে আমরা বসে থাকব কৌশলে।
যখনই প্রয়োজন হবে ব্যবহার করব হৃদয় পিস্তলটি।
আমি বিছানার এক পাশে আর তুমি বসবে ওপাশে।
ঈশ^র চেয়ারে বসে আছে। আমরা আলোতে বসে থাকলাম।
আত্মাগুলি বের করে রাখলাম টেবিলের এক কোণে।

ফিসফিস শব্দ করল কথারা। স্নেহধন্য
বিচিত্র পেশার জানোয়ার ছিল কথাগুলি।

আমাদের দুই জোড়া চোখ ভেন্টিলেটরের
ফাঁক দিয়ে আলো দেখে। আমরা একটি
রেল লাইনের সমান্তরাল মাত্রাকে খুঁজে বের করলাম।
অনুসরণের দৃষ্টি আর ইঙ্গিত শলাকা রাখলাম
টেবিলের এক কোণে। তার সাথে এক বাক্স দেশলাই
আর মোমবাতি।

তারপর বাতি নিভিয়ে দেয়া হলো
আমরা দুজন অন্ধকারে বসে থাকলাম।

প্রিয় বন্ধুগণ কোনো কিছুর জন্যই এ সুযোগ হারাতে চাই না
তুমি আমাতে অবাধ্য হও আর আমিও তোমাতে।

আট এর বিশিষ্ট কবি বদরুল হায়দার আমার অগ্রজ বন্ধুজন।একই জন্ম জেলার সূত্রে তাঁর জন্মভিটা চৌমুহনীতে আমার যাতায়াত ছিল অবাধ। আমি তখন সদ্য স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে চাটখিলে একটা বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করি।অনুজের প্রতি স্নেহবাৎসল্য ভালোবাসা ছিল তাঁর অগাধ।যখনই চৌমুহনীতে তাঁর আস্তানায় গেছি তখনই খুব সাদরে গ্রহণ করতেন। সাহিত্য বিষয়ক নানাহ আলাপচারিতা চলতো দীর্ঘক্ষণ। মাসুম রেজা তরু,সৈয়দ রূপক রশিদ, ম.পানাউল্লাহ সহ আরো অনেকে আসতেন তাঁর আড্ডায়। বদরুল হায়দার নয় এর দশকে বইয়ের আড়ৎ প্রকাশনার মাধ্যমে নতুন কবিদের কাছে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। নতুনদের কাছে টানার এবং ভালোবাসা তাঁর মজ্জাগত স্বভাব বৈকি। গেলেই বৃহত্তর নোয়াখালী থেকে প্রকাশিত সাহিত্য কাগজ হাতে ধরিয়ে দিতে ভুলতেন না। ঢাকায় এলে আজিজ,কাঁটাবন, টিএসসি চলতো আড্ডা।

আজ তাঁর জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর রচিত একটা কবিতা নিয়ে আলোচনা করে অগ্রজের প্রতি জন্মদিনের শুভেচছা জ্ঞাপনের সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না। বদরুল হায়দার মূলতঃ মরমীবাদ প্রেমাশ্র‍য়ী কবিতা লেখায় সিদ্ধহস্ত। তাঁর কবিতায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভাষা অন্যতর দ্যোতনা সৃষ্টি করে। আলোচ্য কবিতার শিরোনাম “তুমি আমাতে অবাধ্য হও আমিও তোমাতে”। এটা নিয়েই আজকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় এবং কিছু লেখার চেষ্টা। কবিতাটির মধ্যে একটা ম্যাজিক রিয়েলিজম কাজ করে।যাহা প্রেমের আখ্যানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। একজন ম্যাজিশিয়ান যেমন দর্শককে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন,বদরুলও পাঠক ঠিক তেমনি একটা ইল্যুশন বা ঘোর তৈরি করার কাজটি করেন এই কবিতার মধ্য দিয়ে। তিনি এইক্ষেত্রে পিনপতন নীরবতা কামনা করেন দয়িতার কাছে। ম্যাজিক বা সাধন মার্ঘের মতো একধরনের আবহ তৈরি করে।প্রিয়তমার কাছে দাবি না ঘুমিয়ে যেনো তারা বসে থাকবেন আলো জ্বেলে। যখন প্রয়োজন হবে তখন হৃদয় পিস্তলটি ব্যবহার করবেন।খুব সাদামাটা গদ্যাশ্রয়ী বর্ননা। তারপরই আত্মাকে বের করলেন। এরপরই কাব্যময় ভাষার দ্যুতি চকিত হয়ে ওঠে।
” ফিসফিস শব্দ করল কথারা। স্নেহধন্য
বিচিত্র পেশার জানোয়ার ছিল কথাগুলি”। ফিসফিস করা কথা যে বিচিত্র পেশার জানোয়ার হতে পারে। এই বোধ ও ভাবনা আমরা তাঁর কাছ থেকে পাই।নতুন স্বাদ, নতুন ব্যঞ্জনায়। মানুষের মনের কথায় যে মরণেরও আঘাত থাকতে পারে,পশুর ভাবনা লুকিয়ে থাকতে পারে এই কবিতায় তার স্বার্থক রূপায়ণ ঘটতে দেখা যায়।বদরুল এইক্ষেত্রে সফল,এবং কবিতাটি কবিতা হয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট কাব্য রসদের যোগান দেয়।

তারপর আবার পরাবাস্তব ঘোরে চলে যান তিনি।অনুসরণের দৃষ্টি ও ইঙ্গিত শলাকায় দেশলাই ও মোমবাতি রাখলেন টেবিলে এবং বাতি নিভিয়ে দিলেন। এরপরই ঘটে মোক্ষম ঘটনা,” তুমি আমাতে অবাধ্য হও আমিও তোমাতে”। কবিতাটি এভাবেই সমাপ্ত হয়।বদরুলের কবিতা আখ্যানধর্মী ও ন্যারেশনাল। সহজ সরল শব্দের গাঁথুনিতে পাঠককে চমকিত করার ক্রীড়াশৈলী রপ্ত করার ভাষা তাঁর সহজাত কাব্যিক প্রকাশ বোধ করি।কবিতাটি যে কেউ এক লহমায় আবৃত্তি করে যেতে পারবে স্বতস্ফূর্ত ভঙ্গিমায়। কোথাও হোঁচট খেতে হবে না। গদ্যছন্দে রচিত কবিতাটি পাঠকের বোধকে খুব সহজে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখে।তাঁর কবিতা আবৃত্তি উপযোগী ও অনবদ্য। কোনও জটিল কাব্যশৈলী বা কৃৎকৌশল তিনি পারতপক্ষে দেখাতে চান না।তাই বোধ করি তিনি জনপ্রিয় ধারাকে কাব্য রুচির সাথে একীভূত করে নিয়ে কাব্যচর্চা করেন।

কবিতার পাশাপাশি গদ্য লেখায়ও তাঁর বিশেষ অভিনিবেশ লক্ষ্য করার মতো।আট এর অনেক কবি শুধুমাত্র কবিতা লেখেই খ্যাতি কুড়িয়েছেন। অনেকের গদ্য লেখায় অনীহা দেখা যায়।বদরুল হায়দার এইক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সক্ষমতার দাবি রাখে। অগ্রজ অনুজ অনেককে নিয়ে গদ্য লিখেছেন তিনি। সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি সাহিত্যের কাগজ ও সংগঠন প্রিয়তা তাঁর আরেক গুণ।কবিতাচর্চা কাগজ ও প্রকাশনায় তরুনদের উঠে আসার পথ করে তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে চলেছেন। কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্যচর্চা এক জটিল কর্ম।অনেকে কাব্যসত্তা হারানোর মিথ্যে ভয়ে গদ্য লেখেন না।এ-শুধু মিথ্যে বাহানা বৈ আর কিছু নয়। কেননা গদ্য লিখতে হলে অনেক জানাশোনা পঠন পাঠনিবিষ্ট হতে হয়। বাংলা সাহিত্যে বোধ করি তাই সমালোচনা সাহিত্য বিকাশ লাভ করেনি। করবে কি করে? কেউ কারো লেখাকে কোনও পাত্তাই দিতে চায় না।নিজ গ্রুপ, কাগজ বা সংগঠনের বাইরে কাউকে মূল্যায়ন করাও পাপবোধ মনে করে।তাছাড়া অনেক কবি আছেন তাঁরা সমালোচনা সহ্য করতে না পেরে পেছনে গালমন্দ করেন এবং তাকে নিষিদ্ধ করেন।বদরুল হায়দার এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।

মনে রাখা চাই পাঠকই প্রকৃত কবিতার চূড়ান্ত মাপকাঠি। তাই একে অন্যের কবিতার গঠনমূলক আলোচনা সমালোচনা করুন।বাংলা সাহিত্য ও বিশ্ব সাহিত্যের সাথে নিবিড় পঠনপাঠন এর মধ্য দিয়ে বাংলা সমালোচনা সাহিত্যকে বিকশিত করার সময় বোধ করি আর হেলাফেলা করা সমীচীন হবে না। কবিতা যেহেতু শিল্পের সর্বোত্তম শাখা, তাই এর প্রকাশ,প্রকরণ,ব্যপ্তি যেনো বৃহত্তর বোধকে লালন করে, সেইদিকে নজর দিলে বাংলা সাহিত্য এক উচ্চকিত আসনে যাবে নিঃসন্দেহে বলা যায়।এইজন্য বিদেশি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকে অনুবাদ করে এবং আমাদের শ্রেষ্ঠ কৃতিকে অনুবাদ করে বিশ্ব দরবারে পোঁছে দিতে হবে।তবেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তথা আমাদের সংস্কৃতি ঋদ্ধিমান হবে।জয়তু কবির জন্মদিন। শতায়ু হোন

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD