শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১০:০১ পূর্বাহ্ন

নীরদচন্দ্র চৌধুরীর আজ মৃত্যুবাষিকী

নীরদচন্দ্র চৌধুরীর আজ মৃত্যুবাষিকী

নীরদচন্দ্র চৌধুরীর আজ মৃত্যুবাষিকী

মননশীল লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরী
আহমেদ জহুর

নীরদচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন খ্যাতনামা বাঙালি মননশীল লেখক ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ। স্কলার এক্সট্রা অর্ডিনারী শীর্ষক ম্যাক্স মুলারের জীবনী লিখে ১৯৭৫ সালে তিনি ভারত সরকারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মাননা সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও তীর্যক প্রকাশভঙ্গীর জন্য বিশেষভাবে আলোচিত ছিলেন। আজ এ খ‍্যাতিমানের ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী, তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি! নীরদচন্দ্র চৌধুরীর জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৩ নভেম্বর কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে। উপেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ও সুশীলা সুন্দরী চৌধুরানীর ৮ সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।

শিক্ষাজীবন….
নীরদচন্দ্র চৌধুরী বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ এবং পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় পড়াশোনা করেন। এফএ পরীক্ষা পাস করে তিনি কলকাতার রিপন কলেজে (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) অন্যতম বাঙালি লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে একত্রে ভর্তি হন। এরপর তিনি কলকাতার অন্যতম খ্যাতিমান স্কটিশ চার্চ কলেজে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। ১৯১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন স্কটিস চার্চ কলেজের ছাত্র হিসেবে তিনি ইতিহাসে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজের সেমিনারে ভারতবর্ষের অতি পরিচিত ব্যক্তিত্ব ও ইতিহাসবেত্তা প্রফেসর কালিদাস নাগের সাথে অংশগ্রহণ করেন। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিতে ভর্তি হলেও ১৯২০-এর অনুষ্ঠিত এমএ পরীক্ষায় অংশ না নেয়ায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে পারেননি। এখানেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি। ইতোমধ্যে ১৯১৭ সালে Objective Methods in History শিরোনামে একটি তাত্ত্বিক প্রবন্ধ রচনা করে তিনি ব‍্যাপক সুনাম অর্জন করেন।

কর্মজীবন….
নীরদ চৌধুরীর কর্মজীবনের সূত্রপাত ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিসাবরক্ষণ অধিদপ্তরে একজন কেরাণী হিসেবে। চাকরির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন ধরনের প্রবন্ধ রচনা করতে থাকেন। জনপ্রিয় সাময়িকীগুলোতে নিবন্ধ পাঠানোর মাধ্যমে লেখার জগতে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম নিবন্ধটি ছিল অষ্টাদশ শতকের বিখ্যাত বাঙালি কবি ভারত চন্দ্রের ওপর। এই নিবন্ধটি তখন কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত ইংরেজি সাময়িকী ‘মডার্ন রিভিউ’-তে স্থান পায়। ইতোমধ্যে ১৯২৪ সালে তাঁর মাতা সুশীলা সুন্দররানী চৌধুরানী পরলোকগমন করেন।

নীরদ হিসাবরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে অল্প কিছুদিন পরই চাকরি ছেড়ে দেন এবং সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেন। ওই সময়ে কলকাতা কলেজ স্কয়ারের কাছাকাছি মির্জাপুর স্ট্রিটে অন্যতম লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সাথে একত্রে বোর্ডার হিসেবে ছিলেন। তিনি তখনকার সময়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় ইংরেজি ও বাংলা সাময়িকী হিসেবে মডার্ন রিভিউ, প্রবাসী এবং শনিবারের চিঠিতে সম্পাদনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি দুটি ক্ষণস্থায়ী অথচ উচ্চস্তরের সাময়িকী ‘সমসাময়িক’ এবং ‘নতুন পত্রিকা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯২৬ সালে দ্য মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় রমানন্দ চ্যাটার্জির অধীনে সহকারী সম্পাদকের চাকরি গ্রহণ করেন। ১৯২৭-এ বাংলা সাময়িকী ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ বছরই রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর সৌজন্য সাক্ষাৎ ঘটে।

পারিবারিক জীবন….
নীরদ চৌধুরী ১৯৩২ সালে লেখিকা অমিয়া ধরের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁদের সংসারে তিনটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর মধ্যম পুত্র কীর্তি নারায়ণ চৌধুরী খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ। জ্যেষ্ঠ পুত্র ধ্রুব নারায়ণ পিতার অনেক অপ্রকাশিত লেখা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন। পৃথ্বী তাঁদের কনিষ্ঠ সন্তান।

রাজনীতির সংস্পর্শ….
১৯৩৭ সালে নীরদচন্দ্র চৌধুরী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদ শরৎ চন্দ্র বসুর একান্ত সচিব হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিতে তিনি খ্যাতিমান মহাপুরুষ যেমন : মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু-সহ অনেক বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতাদের সংস্পর্শ পান। ভারতীয় রাজনীতির অভ্যন্তরে কাজ করার দরুন ও রাজনীতির সাথে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা থাকায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি সম্বন্ধে সন্দিহান হন। নীরদচন্দ্র চৌধুরী স্বাধীনতা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

নতুন লেখালিখি….
সচিব হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি নীরদ চৌধুরী বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক, সাময়িকীগুলোতে প্রবন্ধ রচনা প্রকাশ করতে থাকেন। এছাড়াও, তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও’র (এআইআর) কলকাতা শাখার রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৪১ সালে নীরদ চৌধুরী অল ইন্ডিয়া রেডিও’র দিল্লী শাখায় কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, প্রখ্যাত সম্পাদক, ঐতিহাসিক এবং ঔপন্যাসিক খুশবন্ত সিং নীরদচন্দ্র চৌধুরী’র বন্ধু ছিলেন। The Autobiography of an Unknown Indian প্রকাশ করেন নিরোধ ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে।

বিদেশ গমন….
১৯৫৫ সালে প্রথমবারের মত তিনি বিদেশে যান এবং ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালি ভ্রমণ করেন। এসময়ে A Passage to England এবং The Continent of Circe প্রকাশ করেন। ‘The Continent of Circe : An Essay on the Peoples of India’ বইটির জন্য “Duff Cooper Memorial” পুরস্কার লাভ করেন। The Intellectual in India প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে।

আরো গ্রন্থ প্রকাশ….
নীরদ দ্বিতীয় দফায় ভারত ত্যাগ করে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে পাড়ি জমান ১৯৭০ সালে। এ সময় Scholar Extraordinary বইটি লেখার কাজে হাত দেন। বইটি ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। ইতোমধ্যে ভারতীয় জীবনযাত্রার এক অতি সুন্দর প্রতিচ্ছবি সম্বলিত গ্রন্থ To Live or Not to Live প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে। ১৯৭৫, ১৯৭৬ এবং ১৯৭৯ সালে যথাক্রমে প্রকাশ করেন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বই : Clive of India. A Political and Psychological Essay, Culture in the Vanity Bag. Clothing and Adornment in Passing and Abiding Indiaএবং Hinduism. নীরদের মহান কীতি Thy Hand! Great Anarch! India : 1921-1952 গ্রন্থটি। এটি ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয়। তখন তাঁর বয়স নব্বুই। এ বয়সে তাঁর দৈহিক এবং মানসিক কর্মক্ষমতা অটুট ছিল।

পুরস্কার-সম্মাননা….
পাণ্ডিত্য ও মণীষার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯০ সালে তাঁকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে। ১৯৯২-এ ইংল্যান্ডের রাণী তাঁকে কমান্ডার অব দি অর্ডার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার (সিবিই) উপাধি অর্পণ করেন। এছাড়াও তিনি অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন।

মৃত্যুবরণ….

১০১ বছর বয়সে নীরদচন্দ্র চৌধুরী অক্সফোর্ডে নিজ বাসগৃহে মৃত্যুবরণ করেন।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD