নারীর ক্ষমতায়নে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদান
ঝর্ণা বাড়ৈ
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব একটি ইতিহাস, একটি অনুপ্রেরণার নাম। জীবন শুরু করেছিলেন শত প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে। নিজের আন্তরিকতা, প্রচেষ্টা ও মানসিক দৃঢ়তা দিয়ে এগিয়ে গেছেন তিনি।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীর ক্ষমতায়নের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং শ্রেষ্ঠ স্মরণীয় মানবী। বিশ শতকের প্রথমার্ধে নারী অবরোধের বেড়াজাল উপেক্ষা করে সাহসী পদক্ষেপে বেরিয়ে আসেন তিনি।
সহধর্মিণী হিসেবে নয়, রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে আজীবন প্রিয়তম স্বামী শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াসঙ্গী ছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ইতিহাসের কালজয়ী মহানায়ক শেখ মুজিবের অনুপ্রেরণাদায়িনী হয়ে পাশে ছিলেন।
বাঙালি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে ধাপে বঙ্গমাতার অবদান রয়েছে। আর সেটা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে নয়, একজন দক্ষ নারী সংগঠক হিসেবে। যিনি ধূপের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়সম আসনে অধিষ্ঠিত হতে সহায়তা করেছেন।
বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির দীর্ঘ সংগ্রাম, স্বাধীনতা ও দেশ গঠনে মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতার নামের সাথে শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত নামটি শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। যখনই আমরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা বলি তখনই বঙ্গমাতার নাম চলে আসে।
খোকা থেকে মুজিব, মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং সবশেষে বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে যে নারীর অবদান অনস্বীকার্য তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের নারী জাতির অহংকার শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
যিনি সোনার বাংলা বিনির্মাণে আড়ালে অন্তরালে থেকে রেখেছেন অসামান্য অবদান। যিনি কখনো নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগ বিলাসের কথা ভাবেননি । ভেবেছেন দেশ, দেশের মানুষ আর নেতা কর্মীদের কথা। বঙ্গবন্ধুর বন্দী জীবনে দক্ষ হাতে সামলিয়েছেন ছেলে-মেয়ে, সংসার এবং ভেবেছেন নেতা কর্মীদের কথা। সেই দক্ষ সংগঠক মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
১৯৩০ সালর ৮ আগস্ট শেখ মোহাম্মদ জহুরুল হক এবং হোসেন আরা বেগমের কোল আলো করে শ্রাবণ দুপুরে জন্ম নিল এক মহিয়সী নারী ফজিলাতুন্নেছা যার ডাক নাম রেনু । মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতাকে হারান। তারপরে দু’বছরের মাথায় তাঁর মাকেও হারান। বড় বোন জিনাতুন্নেছা, ডাকনাম জিন্নি ও ছোট বোন ফজিলাতুন্নেছা এই দুই শিশুর দায়িত্ব নেন বঙ্গমাতার দাদা শেখ মো. আবুল কাসেম।
দাদার ইচ্ছায় মাত্র তিন বছর বয়সের ফজিলাতুন্নেছার সাথে দশ বছরের শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়ে হয়। শাশুড়ি সায়রা খাতুন এবং শ্বশুর শেখ লুৎফর রহমানের কাছে তিনি বাড়ির বউ হয়ে থাকেননি, থেকেছেন নিজের সন্তান হয়ে। শিশু অবস্থায় বিয়ে হলেও বঙ্গমাতার সংসার শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর এন্ট্রান্স পাশের পর ১৯৪২ সালে।
ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্থানীয় একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি হলেও তাঁর স্কুল জীবনের পড়ালেখা বেশি দূর এগোয়নি। তিনি ঘরে বসেই পড়ালেখা শিখেছেন। তাঁরা যখন সংসার শুরু করেন, তখন বঙ্গবন্ধুর বয়স ১৯ বছর আর ফজিলাতুন্নেছার বয়স ১০ বছর। স্বামী বাইরে থাকাকালীন সময়ে ফজিলাতুন্নেছা অবসর সময়ে বিভিন্ন রকমের বই পড়তেন, গান শুনতেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনের প্রেরণার বড় উৎস ছিলেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তার অনুপ্রেরনায় শেখ মুজিব হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু, হয়ে উঠেছেন শ্রেষ্ঠ বাঙালি ।
ফজিলাতুন্নেছার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল অতুলনীয়। তিনি সবসময়ই বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে সাহস যোগাতেন। ‘বঙ্গবন্ধুকে যখন প্যারোলে মুক্তি দেয়ার কথা হয় তখন তিনি বাঁধা দেন। তিনি বলেন, আপনাকে নিঃশর্ত মুক্তি না দিলে আপনি প্যারোলে মুক্তি নেবেন না। স্বাধীনতার নেপথ্য সৈনিক হিসেবে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুকে সাহস যুগিয়েছেন । তিনি দেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। তাই ইতিহাস থেকে তাকে সরিয়ে ফেলার কোন সুযোগ নেই।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণের সঙ্গে বঙ্গমাতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকারের দায়ের করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জন বাঙালি নৌ ও সেনাবাহিনীর সদস্য এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র্রদ্রোহের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা হয়।
বঙ্গবন্ধু এ মামলায় বিচলিত না হয়ে আইনিভাবে মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আইনজীবীদের অর্থ জোগানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন। এ মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির মুক্তি দাবিতে বাঙালি রাস্তায় নামে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজপথ বিক্ষোভে জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকেও গ্রেফতারের হুমকি দেয়। আন্দোলনের বেগবানতায় কার্যত তখন সরকার পিছু হটে। পাকিস্তান সরকার এ সময় লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্যারোলে মুক্তির সিদ্ধান্তে বেঁকে বসেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে জোরালো আপত্তি জানান।
পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে প্যারোলে নয়; নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। তিনি কারাগারে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লাহোর বৈঠকে যেতে নিষেধ করেন। তিনি আরও বুঝতে পেরেছিলেন, শেখ মুজিবের ব্যাপারে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ। পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবে।
ফজিলাতুন্নেছার পরামর্শে শেখ মুজিব অনড় থাকেন। প্যারোলে মুক্তির ক্ষেত্রে তিনি অসম্মতি প্রকাশ করেন। ইতিমধ্যে শেখ মুজিবের মুক্তি আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি লাভ করেন। পরদিন অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালি
Leave a Reply