দুটি আই
কাজী জহিরুল ইসলাম
আমাদের তো আলাদা কোনো কাপ ছিল না, চা কিংবা কফির জন্য
ডাঁটভাঙা একটিমাত্র সিরামিকের কাপে দুজনের উষ্ণ চুমুক; দারিদ্র কী মধুর!
আমি প্রায়শই ‘চুমুক’ শব্দটি থেকে ‘ক’ অক্ষর মুছে দেবার বাহানা করতাম,
তুমি এতে ক্ষেপে গিয়ে তুমুল তুলকালাম কাণ্ড ঘটানোর জন্য ডানা ঝাপটাতে,
শেষমেশ ওই শব্দের জাদুতেই তুমি বশ।
কতো কতো দিন একটিমাত্র প্লেটেই দুজনের অন্ন-ব্যাঞ্জনাহারে রসনা-তৃপ্তি।
এমন সকাল কত কেটে গেছে, একটিই ডিম পোচ ফুটো করে
জোড়াশালিকের মতো চঞ্চু ডুবিয়ে চুমুক দিয়েছি কুসুমে।
আলাদা বসার ঘর, সে-তো ছিল স্বপ্ন!
এটা-সেটা কতো কাজ তখন সংসারে, ক্লান্ত হয়ে শোবার ঘরের বিছানায়
তুমি এসে বসতে আমার গা ঘেষে; কাঁধের
ওপর তোমার নরোম হাতটা তুলে দিতে; কী এক নির্লিপ্ত শান্তি তোমার সমস্ত মুখে;
আমাদের জানালায় কোনো পর্দা ছিল না, তোমার
চোখের নাজুক পর্দা কেঁপে উঠতো তখন দ্বিধায়,লজ্জায়।
তুমি দূরে সরে যেতে চাইলে কম্পিত দেহটাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতাম,
দুজনের হৃৎপিণ্ডের দুলুনি তখন অভিন্ন দেয়ালঘড়ির এক দোলকের ছন্দে মিশে যেত।
আজ দোতলায় কতো বড়ো একটি অফিসঘর আমাদের,
অথচ শেয়ার করতে গেলেই ইস্পাতের সঙ্গে ইস্পাতের ঘর্ষণে ভয়ঙ্কর আওয়াজ ওঠে।
এখন আমরা খুব বড় একটি হোয়াইট বোর্ডও শেয়ার করতে পারি না;
একজন অন্যজনের অক্ষরগুলো মুছে দিই ব্যাক্তিত্বের ইরেজার দিয়ে।
আমরা তো মূলত পরস্পরকে জড়াজড়ি করেই বেড়ে উঠেছি,
ঝড়ে,জলোচ্ছাসে, দারিদ্রে, স্বপ্নের অতল ঐশ্বর্যে
কখনো আমরা একে অন্যের হাত ছাড়িনি।
অথচ কী কাণ্ড দেখো,
জড়াজড়ি করে বড়ো হতে হতেই
দুটি অচেনা গাছ আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
এখনও তুমি আমার জন্যে কই মাছের দোপেঁয়াজা রাঁধো,
কাচা আম দিয়ে মশুরের ডাল,
বিবিখানা পিঠা,
সবুজ কাগজী লেবু কেটে পছন্দের টুকরোটি বের করতে গিয়ে এখনও আগের মতোই ভুল করো।
তবু টের পাই সব কিছু আগের মতো নেই,
কাছে আসতে আসতেই আমরা হয়ত অনেকটা দূরে সরে গেছি।
সেই বৃদ্ধ অধ্যাপকের পরামর্শটি মনে আছে তোমার? বিয়ের পরদিন যিনি বলেছিলেন,
কি পেলাম তা নয়, দুজনেই সব সময় ভাববে কি দিলাম, আর কি আছে আমার যা এখনও দিইনি তাকে;
তিনি ‘উই’ শব্দটির ওপর খুব জোর দিয়ে বলেছিলেন,
আজ থেকে আর নয় ‘আই’,
এখন থেকে সব কিছু ‘উই’…
দুটো ‘আই’ পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে একটি ‘উই’ হতেই তো চেয়েছিল সমস্ত জীবন।
হয়েও ছিল হয়ত,
আজ কেন মনে হচ্ছে এতো আদরে লালন করা
‘উই’ বৃক্ষটি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে,
ওর ভেতর থেকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে চিরসত্যের মতো দুটি আত্মবিশ্বাসী ‘আই’।
মানুষের ভেতরের ‘আই’ কখনো মরে না,
ভালোবাসার ওম পেলে ওরা কেবল ঘুমিয়ে থাকে ‘উই’য়ের কোলে,
প্রেমের উষ্ণতা কমে গেলেই জেগে ওঠে ভয়ঙ্কর ক্রোধে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১১ জুন ২০২১।
[সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: এটা কবিতা, ব্যক্তিজীবনের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর]
Leave a Reply