শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৮ পূর্বাহ্ন

জুড়ীতে দশম শতকের চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় -হাসনাইন সাজ্জাদী

জুড়ীতে দশম শতকের চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় -হাসনাইন সাজ্জাদী

দশম শতকে
চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় ছিল
জুড়ীতে

হাসনাইন সাজ্জাদীঃ জুড়ী উপজেলার সাগরনাল ইউনিয়নের দীঘিরপাড়ে অবস্থিত কথিত শ্রীহট্টের চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় অনুসন্ধান প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক, আঞ্চলিক পরিচালকের দপ্তর, চট্টগ্রামকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হলেও করোনাভাইরাসের মহামারীকালে অনুসন্ধান প্রক্রিয়া যদিও এখন স্থবির।

একটি সুত্রমতে, গত বছরের ২২ ও ২৩ জুলাই প্রাথমিক অনুসন্ধান চলে বলে।
গত ১৫ এপ্রিল ২০২০ সিলেটের পূর্বাঞ্চলের সাপ্তাহিক দিবালোক পত্রিকায় ‘শ্রীহট্টের চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় এক অনন্য নিদর্শন’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের সূত্র উল্লেখ করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপপরিচালক (প্রত্নসম্পদ ও সংরক্ষণ) মো. আমিরুজ্জামান গত ১৫ জুুলাই ২০২০ স্বাক্ষরিত এক পত্রে উল্লেখ করেন, মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার সাগরনাল ইউনিয়নের দীঘিরপাড় এলাকায় চন্দ্র বংশীয় বৌদ্ধ রাজা শ্রী চন্দ্র্র কর্তৃক স্থাপিত কথিত শ্রীহট্টের চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরাকীর্তি সম্পর্কে সরেজমিন জরিপ ও পরিদর্শন প্রতিবেদন দেন।

কথিত বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরাকীর্তি Antiquitles Act-1968 অনুসারে সংরক্ষিত ঘোষণা ও সংস্কার-সংরক্ষণের কোন সুযোগ আছে কি না এ সম্পর্কে সরেজমিন পরিদর্শন পূর্বক আলোকচিত্র ও মতামতসহ প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়।

সাপ্তাহিক দিবালোক পত্রিকায় লেখক ও ব্যাংকার অমিতাভ পাল চৌধুরী’র ‘শ্রীহট্টের চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়: এক অনন্য নিদর্শন’ শিরোনামে প্রকাশিত লেখাটি তুলে ধরা হলে।

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে সমগ্র ভারতবর্ষে শ্রীহট্ট একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত গুরুগৃহ কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা মঠভিত্তিক শিক্ষায় রুপান্তর ঘটে। আর সেই ধারায় শ্রীহট্টে দশম শতকের প্রথম ভাগে একটি উচ্চতর বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠে। ভাবতে ভাল লাগে পৃথিবীর খ্যাতনামা অক্সফোর্ড (১০৯৬খ্রি:), ক্যামব্রিজ (১২০৯খ্রি:) ও বলোগনার (১০৮৮খ্রিঃ)-এর মত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগে শ্রীহট্টে জ্ঞানচর্চার এই অনন্য কীর্তি রচিত হয়।

১৯৬১ সালে মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পশ্চিমভাগ গ্রাম থেকে একটি তাম্ভ্রশাসন আবিষ্কৃত হয়।

উল্লেখ্য যে, প্রাচীনকালে রাজারা তামার পাতে রাজকীয় ঘোষণা ও আনুশাসন খোদাই করে রাখতেন। তামার পাতে খোদিত এসব দলিল তাম্ভ্রশাসন নামে পরিচিত। চন্দ্রবংশীয় বৌদ্ধ রাজা শ্রীচন্দ্র এই তাম্ভ্রশাসন প্রদান করেছিলেন।

শ্রীচন্দ্রের সাম্ভ্রজ্যভুক্ত এলাকার মধ্যে মানিকগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুরের পদ্মা তীরবর্তী এলাকা, শ্রীহট্ট অঞ্চল ও কুমিল্লা, নোয়াখালীর সমতট অঞ্চল ছিল। বিক্রমপুর তাঁর রাজধানী ছিল। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার তার বাংলাদেশের ইতিহাস (প্রাচীন যুগ) গ্রন্থে শ্রীচন্দ্রের শাসনকাল উল্লেখ করেছেন ৯০৫-৯৫৫ সাল।

পশ্চিমভাগ তাম্ভ্রশাসনের ভাষ্যানুযায়ী খ্রিস্টীয় দশম শতকের প্রথম ভাগে (আনুমানিক ৯৩৫খ্রি:) শ্রীহট্টে একটি উচ্চতর বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। চন্দ্রবংশীয় বৌদ্ধ রাজা শ্রীচন্দ্র এই চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সম্পূর্ণ রাজকীয় অনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতায় বিশাল এই বিদ্যাপীঠটি গড়ে উঠেছিল। প্রতিষ্ঠাতা শ্রীচন্দ্র প্রতিষ্ঠানটি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ কল্পে ৪০০ পাটক জমি (১ পাঠক- ৫০ একর বা ১৫০ বিঘা) বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বরাদ্দ করেছিলেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় কালের করাল গ্রাসে পতিত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত এই বিদ্যাপীঠের কথা প্রায় সকলের অজানা। বিদ্যাপীঠটির ইতিহাস রচনার উপকরণও সীমিত।

প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ কমলাকান্ত গুপ্ত চৌধুরী তার বিখ্যাত ‘ÔCopper plates of sylhet’ গ্রন্থে পশ্চিমভাগ তাম্ভ্রশাসনের বক্তব্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এবং তাম্ভ্রশাসন সম্পর্কিত তার রচিত কিছু প্রবন্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।

সুজিত চৌধুরী তার শ্রীহট্ট কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস এবং নীহার রঞ্জন রায় তার বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদিপর্ব) গ্রন্থে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কিছু তথ্য সংযোজন করেছেন। এছাড়াও মো. জহিরুল হক ও বায়োজিত আলম প্রাচীন সিলেটের চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যাল: একটি ইতিহাসভিত্তিক পর্যালোচনা শিরোনামে একটি গবেষনা প্রবন্ধ রচনা করেন।

চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ আজও অনাবিষ্কৃত। তবে পশ্চিমভাগ তাম্ভ্রশাসনের সূত্রানুযায়ী খ্রিস্টীয় দশ শতকের প্রথম ভাগে উত্তরে কুশিয়ারা নদী, দক্ষিণ ও পশ্চিমে মনু নদী এবং পূর্বে ইন্দেশ্বরের পাহাড়ি অঞ্চল বা পাথরিয়া অঞ্চল এই সীমানার মধ্যে জুড়ীনদীর অনতিদূর চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল।জুড়ী গাঙ কেন্দ্রিক একটি প্রাচীন সভ্যতার কথা বরমচালে প্রাপ্ত শিলালিপিতেও উল্লেখ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ মৌলভীবাজার জেলার জুড়ি উপজেলার সাগরনাল ইউনিয়নের দীঘিরপাড় এলাকার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। এই ইঙ্গিতের পেছনেও কিছু যুক্তি রয়েছে। যেমন, দীঘিরপাড় এলাকায় কোনো এককালে বড় শিক্ষাঙ্গন ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।লোকমুখে এমন ধারণা হাজার বছর ধরে প্রচারিত হয়ে আসছে।এছাড়াও দীঘিরপাড় এলাকায় মাটির নিচে এখনও প্রাচীনকালের তৈরী বড় বড় ইট এবং আসবাবপত্র পাওয়া যায়।

চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো সম্পর্কে যা জানা যায় তাহল, নয়টি মঠ (একটি ব্রহ্মার মঠ, চারটি বঙ্গাল মঠ ও চারটি দেশান্তরীয় মঠ) নিয়ে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল।

ব্রহ্মার মঠের যাবতীয় কার্য নির্বাহের জন্য বরাদ্দ ছিল ১২০ পাটক জমি। বাকি আটটি মঠের জন্য (৩৫৮-২৮০) ২৮০ পাটক জমি বরাদ্দ ছিল। দুই ধরণের ৪টি করে মোট ৮টি মঠের প্রতিটি ছিল বড় বড় ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নি:সন্দেহে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় ছিল হিন্দু শাস্ত্রবিদ্যা অধ্যয়নের বিশাল কেন্দ্র।

চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল অতীব মনোরম এবং নির্মাণশৈলী কারুকার্যে সুশোভিত। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত সংস্কার ব্যয়নির্বাহের জন্য ৪৭ পাটক জমি বরাদ্দ ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল সম্পূর্ণ আবাসিক। শিক্ষার্থীদের থাকা খাওয়া ও পড়ার খরচ কর্তৃপক্ষ বহন করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক ও অতিথিদের থাকার জন্য অতিথিশালা ছিল। প্রতিদিন ৫ জন অতিথি সেবার জন্য ৫ পাটক জমি বরাদ্দ ছিল। তাম্ভ্রশাসন অনুযায়ী ব্রাহ্মণগণ চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিলেন। এর জন্য বরাদ্দ ছিল তাদের প্রত্যেকের নামে এক পাটক জমি। পশ্চিম ভাগ তাম্ভ্রশাসনে ৩৬ জন ব্রাহ্মণের নাম পাওয়া যায়।

চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত বিভিন্ন পদের দায়িত্ব প্রাপ্তরা সকলেই নিজ নিজ দায়িত্ব প্রতিপালনের বিনিময়ে বেতনের পরিবর্তে জমির উপস্বত্ব ভোগ করতেন।

বিভিন্ন ধরনের পদবীধারীরা তাদের কাজের বিনিময়ে কতটুকু জমির অধিকার পেয়েছিলেন তা সংক্ষিপ্ত ভাবে একটি সারণির মাধ্যমে তুলে ধরা হল:

চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত ছিল চতুর্বেদ অর্থাৎ ঋক, সাম, যজু ও অধর্ববেদ এবং সপ্তম শতকের বৌদ্ধ ব্যাকরণবিদ চান্দ্রগামীর চান্দ্র ব্যাকরণ। গবেষকরা অনুমান করেন যে, চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু শাস্ত্রবিদ্যা অধ্যয়নের পাশাপাশি চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতিষবিদ্যা, শল্যবিদ্যা, ধাতু বিদ্যা, হেতু বিদ্যা, শব্দবিদ্যা, লোক বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান সহ আরো অনেক বিষয় পড়ানো হত। দশম শতকে শ্রীহট্টে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্থিত্ত একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

দুঃখের বিষয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা দীক্ষার যে বিপুল আয়োজন ছিল পরবর্তীতে তার সামান্য উত্তরাধিকারী পর্যন্ত রইল না। ইখতেখার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছিলেন। শ্রীহট্টের এই চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় কোন শাসকের রোষানলে পড়ে না অন্য কোন ভাবে ধ্বংস হয়েছিল তা জানা যায় না।পূর্ব ভারতের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলও একটি কারণ হতে পারে।তাছাড়া বর্ণ হিন্দুদের নানামুখি আক্রমনতো ছিলই।

ভারতের বিহারের পাটনা জেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। ঠিক এই ভাবে ব্যাপক খনন কার্য চালিয়ে অনুসন্ধান করলে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যেতে পারে বলে আশাবাদী অভিজ্ঞ মহল ও সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD