শুভ জন্মদিন অভিজিৎ রায়…
.
বাংলাদেশে বিজ্ঞান মনস্ক লেখকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ। মুক্তচিন্তা, মানবতাবোধ আর বিজ্ঞান ছিলো তাঁর অনন্ত পথযাত্রা। লেখায় আঘাত করতে চেয়েছিলেন ধর্মান্ধতা কে, কোন ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। নিজের লেখায় খুলে দিয়েছিলেন সমাজের চিরচেনা মুখোশ।
.
আজীবন তিনি ছিলেন মনবতাবাদী।
যদিও তিনি অবিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু বলতেন,
.
“আমি নাস্তিক। কিন্তু আমার আশে পাশের বহু কাছের মানুষজন বন্ধু বান্ধবই মুসলিম। তাদের উপর আমার কোন রাগ নেই, নেই কোন ঘৃণা। তাদের আনন্দের দিনে আমিও আনন্দিত হই। তাদের উপর নিপীড়ন হলে আমিও বেদনার্ত হই। প্যালেস্টাইনে বা কাশ্মীরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে কার্পণ্য বোধ করি না। অতীতেও দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো। এটাই আমার মানবতার শিক্ষা।”
.
পেশায় ছিলেন প্রকৌশলী । কিন্তু তাঁর নেশা ছিলো ব্লগ আর বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখিতে। তিনি মোট ১০টি বই প্রকাশ করেন। বিজ্ঞান, নাস্তিকতাবাদ, বাস্তববাদ, সন্দেহবাদ ও যৌক্তিকতার ওপর ভিত্তি করে রচিত অবিশ্বাসের দর্শন এবং বিশ্বাসের ভাইরাস।
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি, সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান, অবিশ্বাসের দর্শন, বিশ্বাস ও বিজ্ঞান,শূন্য থেকে মহাবিশ্ব , কিংবা বিশ্বাসের ভাইরাস। কি অসামান্য তাঁর যুক্তি বুদ্ধি, বিজ্ঞানভিত্তিক মতামত। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে লিখেছিলেন :
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে।
.
বাংলাদেশে আমাদের মাঝে, কেঁচোর মতো অজস্র মেরুদণ্ডহীন উগ্রবাদীর বসবাস। যারা ভয়ে গর্তে সিধিয়ে পড়ি, বিপদ দেখলে লুকিয়ে বাঁচি। অথচ তাঁর অভ্যাস ছিলো স্রোতের বিপরীতে চলে সত্য জানান দেয়া। যা তাঁর “অবিশ্বাসের দর্শন” এবং “বিশ্বাসের ভাইরাস” বই পড়লে বোঝা যায়। কিন্তু জবাবে তাঁর উপর এলো চাপাতির কোপ। যারা লেখার বদলে বদলা নেয় চাপাতির কোপে।
.
তাঁকে বোঝার সামর্থ্য এই উগ্রবাদীদের হয়নি কখনো হবেনা। তাঁকে বোঝার যোগ্যতা এই অজ্ঞ হিংস্র জীবদের কখনোই হবেনা। বাংলাদেশ ছিলো তাঁর ভীষণ প্রিয়। প্রতিবছরই আমেরিকা থেকে ছুটে আসতেন কেবলই মাতৃভূমির টানে। সেই মাতৃভূমিতে, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বইমেলার ধারেই তাঁকে খুন হতে হলো চাপাতির কোপে। এরচেয়ে ভয়াবহতা আর কি হতে পারে?
.
ধর্মান্ধ আর উগ্রবাদী দেশে গোবরে পদ্মফুল হয়ে জন্মেছিলেন তিনি। উলুবনে মুক্তা ছড়াতে চেয়েছিলেন। বিপরীতে কি হলো…!
তাঁর বইয়ের নামের মতোই তিনিও আলো হাতে চললেন আঁধারের যাত্রী হয়ে।
.
অভিজিৎ রায়ের জন্ম হয়েছিলো আসামের শিবনগরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। তাঁর
গর্ভবতী মাকে ভারতের আসামে রেখে বাবা অজয় রায় অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। আসামের শিবনগরের নাজিরা ম্যাটারনিটি সেন্টারে জন্ম হয়েছিলো তাঁর।
.
মূলত বাবার হাতেই তাঁর মুক্তচিন্তার হাতেখড়ি। লিখেছিলেন নিজেই-
.
“বাবা আমাকে ‘রাজপুত্রে’র মত বড় করতে পারেননি বটে, কিন্তু বাবাই আমাকে যত রাজ্যের বইয়ের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের শেলফে হাজারো বইয়ের পাশাপাশি ছিলো মুক্তধারার কিশোর –বিজ্ঞানের মজার মজার সমস্ত বই। জাফর ইকবালের ‘মহাকাশে মহাত্রাশ’ কিংবা স্বপন কুমার গায়েনের ‘স্বাতীর কীর্তি’ কিংবা ‘বার্ণাডের তারা’ এগুলো তার কল্যানেই পড়া। বাবাই আমাকে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন সুকুমার রায়ের রচনা সমগ্র। হযবরল-এর বিড়াল, পাগলা দাশু আর হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রীর কথা জেনেছি তার কাছ থেকেই। বাবাই আমার মনে বপন করেছিলেন মুক্তবুদ্ধি আর সংশয়ের প্রথম বীজ। বাবাই আমাকে আবৃত্তি করতে শিখিয়েছিলেন রবিঠাকুরের প্রশ্ন কবিতা ।”
যে পথে থাকে পদে পদে ভয়, সে পথে ঝুঁকি সত্ত্বেও তিনি এগিয়েছেন দৃঢ়চিত্তে। তাইতো তিনি থাকবেন মহাকালের বুকে নক্ষত্র রূপে।
.
আজ অভিজিৎ রায়ের জন্মদিন। বিনম্র শ্রদ্ধা অভিজিৎ রায়ের প্রতি। 🙏💕
.
ছবি- ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে ছোট্ট অভিজিৎ।বাংলাদেশের দুস্পাপ্য ছবির এলবাম থেকে নেয়া…
Leave a Reply