তুমি কি দেখোনি বাংলা ছায়াছবির ক্ষয়!

রিপোর্টারের নাম / ১০৬৭ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : শনিবার, ১২ জুন, ২০২১
তুমি কি দেখোনি বাংলা ছায়াছবির ক্ষয়!

তুমি কি দেখোনি বাংলা ছায়াছবির ক্ষয়!

লিয়াকত হোসেন খোকন

কাহিনি, অভিনয়, দৃশ্যায়ন, গান, আবহসংগীত দর্শকের মন স্পর্শ করতে পারলেই সেই সিনেমা বা ফিল্ম হয় সফল। তবেই তো হবে দর্শকের ভিড়। এখন যারা ছবি বানান তারা সবদিক দিয়েই দুর্বল, তাই যদি না হতো তাহলে দর্শক তো সিনেমা হলে যেতোই – যেতো ।

সেই কবে
রূপবান দেখতে জনতার ঢল নেমেছিল ‌ঃ
অতীতে মনকাড়া ছবি হতো বলেই তো ১৯৬৫ সালে ঢাকার ‘রূপবান’ ছবি দেখবার জন্য দলে দলে দর্শক ভিড় করত ছবিঘরে। যে করেই হোক টিকিট পেতেই হবে, না পেলে ব্লাকাররা তো রয়েছে – ক্ষতি কী, এক টাকার টিকিট দশগুণ বেশি দিয়ে কিনে (১৯৬৫) দর্শক ছবি দেখেছেন দিনের পর দিন। ওই যে, রূপালি পর্দায় দেখতে হবে‘ রূপবান’-এর দুঃখদুর্দশা, বনবাসে যাওয়া – শুনতে হবে – ‘ও দাইমা কীসের বাদ্য বাজে’ কিংবা ‘সাগর কুলের নাইয়ারে’।

শুধু ‘রূপবান’ কেন, সেকালে ঢাকার বহু ছবি হিট হয়েছিল ছবির কাহিনি, অভিনয় ও গানের কারণে। দর্শক দিনের পর দিন দেখেছে সুমিতা দেবী অভিনীত – এদেশ তোমার আমার, আকাশ আর মাটি, কখনো আসেনি; চিত্রা সিনহা অভিনীত – তোমার আমার, গোধূলির প্রেম, রাজধানীর বুকে; রহমান অভিনীত – হারানো দিন; রওশন আরা অভিনীত – নতুন সুর, যে নদী মরুপথে; সুলতানা জামান অভিনীত – জোয়ার এলো প্রভৃতি। এসব ছবি ও তারকারা সেদিনের দর্শকের স্মৃতিতে অমলিন হয়েই থাকল।

সিনেমা দেখতো বাবা – মা – সন্তানরা মিলেমিশে ঃ
সেই যুগে (১৯৫৬ থেকে ১৯৭৫) বাবা, মা, পুত্রকন্যা সবাই মিলেমিশে ইভনিং শো, নাইট শো দেখত। সিনেমা দেখার গৌরবোজ্জ্বল সেই দিনগুলোর কথা এই ৬৭ বছর বয়সে এসে ক্ষণে ক্ষণে হৃদয়ে জাগায়। আর এ প্রজন্ম, নিজের সন্তানদের কথাই বলি, তাদেরকে সিনেমা হলে কখনো যেতে দেখিনি – একজনার বয়স চব্বিশ , অপরজনের বয়স বাইশ ।

ঢাকার সিনেমার প্রতি নেই তাদের আগ্রহ ও আকর্ষণ। এটা কাউকে আঘাত করে বলছি না। সিনেমার প্রতি আজও অগাধ ভালোবাসা রয়ে গেছে, সেই টানে বলছি। আমরা তো বড়ো হয়েছি সিনেমা দেখে দেখে। আমাদের স্কুলজীবনে প্রধান শখ ছিল সিনেমা দেখা, গান শোনা। ভালো লাগা গানগুলো গলা ছেড়ে ক্লাসমেটরা গাইত।

ছায়াছবির গান ছিল জনপ্রিয় –
এত সুর আর এত গান ঃ
আহা শৈশবের বন্ধু ক্লাসমেট অনিল গলা ছেড়ে গাইত : ‘এত সুর আর এত গান যদি কোনোদিন থেমে যায়, জানি তুমি ভুলে যাবে যে আমায়।’ সেই ক্লাসমেট বন্ধুটি অনেক আগেই স্বর্গলোকে চলে গেছে।


স্মৃতিতে আজও জাগে, যেমন – ‘শাপমুক্তি’ ছবিতে তৃপ্তি সেনের গাওয়া – ‘একটি পয়সা দাওগো বাবু’; ‘শেষ পরিচয়’ ছবিতে লতা মুঙ্গেশকরের গাওয়া – ‘কত যে কথা ছিল’; বেচু দত্তের গাওয়া – ‘দুরাশা যে জানি জানি ওগো তোমারে চাওয়ার’; জগন্ময় মিত্রের – ‘ভুলি নাই ভুলি নাই’; ‘হারানো সুর’ ছবিতে গীতা দত্তের গাওয়া – ‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার’ –
ইত্যাদি। তখন তো ফিল্মের গানের পাশাপাশি আধুনিক বাংলা গানও জনপ্রিয় ছিল।

কত ছবি – কত তারকা ঃ
ধারাবাহিকভাবে বলতে হয় বাবা-কাকাদের যুগে দেবদাস (১৯৩৫), মুক্তি (১৯৩৭), বিদ্যাপতি (১৯৩৮), সাপুড়ে (১৯৩৯), পরাজয় (১৯৪০), শেষ উত্তর (১৯৪২), যোগাযোগ (১৯৪৩), নীলাঙ্গুরীয় (১৯৪৪), চন্দ্রশেখর (১৯৪৭) প্রভৃতি ছবির ছিল জয়জয়কার।


তখন তো দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় , প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া, যমুনা দেবী, কানন দেবী, চন্দ্রাবতী, অশোক কুমার, দেবিকা রানি – প্রমুখ তারকার যুগ।


আমাদের যুগে উত্তম-সুচিত্রা সেনের – পথে হলো দেরি, সাগরিকা, মরণের পরে, সবার উপরে, শিল্পী; এ ছাড়া চিত্রা সিনহার – রাজধানীর বুকে, রাজা এলো শহরে; সুলতানা জামানের – মালা, চান্দা, মাটির পাহাড়, ময়ূরপঙ্খী , জংলি ফুল, জানাজানি, সাতরং – কত কী!


সে যুগের ভালোলাগা ছবির ফিরিস্তি দিয়ে এক জনমে তো আর শেষ হবে না।

নায়িকা দেখার স্মৃতি ঃ
ছবি দেখতে দেখতে ভালো লেগে যেত কোনো কোনো নায়িকাকে, এমনি একজন হলেন –
সুরাইয়া, যদিও তিনি ছিলেন হিন্দি ছবির নায়িকা। ‘দিল্লাগী’ ছবিতে তাঁরই কণ্ঠে ‘মুড়লি ওয়ালে মুড়লি বাজা শোনো শোনো মুড়লিকো নাচে দিয়া লাগা বালাম ছে লাগা বালাম…’ শুনতে শুনতে পর্দায় তাঁর
নৃত্য দেখে কত দর্শক যে তাঁকে স্পর্শ
করতে ব্যাকুল হয়েছিল – সে-কথা ভুলি কেমনে।


আমি তো সুরাইয়াকে মনে রেখে ২৯ বছর বয়সে (১৯৮১ সালে) মুম্বাইতে (তখন বোম্বে) গিয়ে মেরিন ড্রাইভের কৃষ্ণামহলে ঠিকই খুঁজে বের করেছিলাম তাঁকে। অনেক সাধের প্রিয় নায়িকা-গায়িকা সুরাইয়ার সাথে দেখা করে তার হাতখানি স্পর্শ করে, জিজ্ঞেস করেছিলাম, দেব আনন্দকে পাননি বলে বিয়ে থা করলেন না কেন?


উঁনি মুচকি হেসে হিন্দিতে যা বলেছিলেন তার বাংলা হলো : ‘এজন্য দায়ী আমার নানি বাদশা বেগম। উঁনিই বাধা দিয়েছিলেন। দেব আর আমি লুকিয়ে আগ্রার তাজমহলে গিয়ে বিয়ে করার প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। সে সৌভাগ্যও হলো না। প্রতিনিয়ত, ফোন আসত কারা যেন হুমকি দিত এই বলে যে – দেব হিন্দু তাই ওকে বিয়ে করলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লেগে যাবে। এই ভয়ে বিয়ে করতে সাহস দেখালাম না। 

এখন তো ৫১ কী ৫২ বছর বয়স – বিয়ে করার আগ্রহ যে হারিয়েছি। তুমি সুদূর পূর্ববাংলা থেকে আমাকে দেখতে এলে বলে এই গোলাপটি নাও। হাতে তুলে দিয়ে তিনি বললেন, আর হয়ত এ জীবনে নাও দেখা হতে পারে…।”
সেদিন অর্থাৎ ১৯৮১ সাল তো চলে গেছে,
সুরাইয়াও আজ বেঁচে নেই।
আমারও যে পড়ন্ত বেলা।

হারিয়ে যাচ্ছে সিনেমা হল ঃ
অতীতে সিনেমার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ ছিল, আজ কোথায় গেল সে-দিন। এখন তো দেখি বাঙলাদেশের তথ্যমন্ত্রী, সংস্কৃতিমন্ত্রী ঢাকার চলচ্চিত্র প্রচারণায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। তারপরেও দর্শকের ভিড় ছবিঘরের দিকে উল্লেখ করার মতো নয়। সেই যুগে সিনেমার প্রচার-প্রচারণা বলতে এইটুকু ছিল, সিনেমা হলের কর্মীরা পায়ে হেঁটে ছবির লিফলেট বিতরণ করার জন্য রাস্তায় বের হতেন মিনিট দশেক সময় হাতে নিয়ে। তবুও দলে দলে জনতা ভিড় করত ছবিঘরের সামনে।


মনে পড়ে পিরোজপুরের ইরা টকিজের কথা। পান্তাডুবির সিদ্দিক ‘জোয়ার এলো’ ছবিটা শতাধিকবার দেখে বিকেলবেলা হলের সামনে নেচে নেচে কোমর দুলিয়ে গাইতেন : “মনে যে লাগে এত রং ও রঙিলা’।


যারা ছবিঘরে ঢুকবার টিকিট পেত না তারা বড়ো আগ্রহ নিয়ে সিদ্দিকের নাচ দেখেই খুশি হয়ে বাড়ি ফিরে যেতেন।
সে যুগ চলে গেছে – সেই সিদ্দিকও নেই, ইরা টকিজও বন্ধ হয়ে গেছে বহু বছর আগে। সিনেমা হলের
মালিক বাদশা-মানিকও মারা গেছেন।


ছবি দেখতে দলে দলে দর্শক আসে না বলে কত সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেল। গুলিস্তান, মুন, স্টার, শাবিস্তান, লায়ন, আলেয়া – দর্শকের অভাবে বিলুপ্ত ঘটে যাচ্ছে বড় সাধের সিনেমা হল ।

সাধনা বসু এসেছিলেন তাজমহলে ঃ
তৎকালীন পূর্ব বাংলার ( বর্তমানে বাংলাদেশ ) ঢাকার তাজমহল সিনেমা হলও আজ নেই – ‘কুমকুম’ ছবি প্রদর্শনের সময় ঢাকার তাজমহল প্রেক্ষাগৃহে এসেছিলেন বিখ্যাত চিত্রনায়িকা – নৃত্যশিল্পী সাধনা বসু।
তাঁকে দেখবার জন্য পাবলিকের ঢল নেমেছিল।

নাগিনের বীণা শুনে 🐍 দলে দলে আসতো সিনেমা হলে……. 🐍 🐍 🐍
বৈজয়ন্তীমালা অভিনীত ‘নাগিন’ ছবির নাগিনের বীণ শুনে ছবিঘরে শতাধিক 🐍 🐍 🐍🐍🐍🐍 🐍🐍🐍🐍🐍🐍🐍🐍🐍🐍🐍🐍🐍🐍🐍🐍🐍🐍🐍🐍🐍 সাপ সাপুড়ে ছুটে এসেছিল। তবে এখনকার ছবিতে নাগিনের বীণ বাজলেও দেখা নেই সাপের। সাপেরাও যেন মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে আজ। যারা ছবি বানায় তাদের মেধার অভাব বলেই বাংলা
ছায়াছবির দৈন্যদশা চলছে গত দেড় যুগেরও আগে থেকে।
মাঝে মাঝে শুনি, ভালো ভালো শিল্পীরা ছবি করছেন তারপরও দর্শকের ভিড় পড়ছে না। কী নির্মম পতন বাঙলা মুভি বা ফিল্মের…।

বাংলা ফিল্মের পরাজয়
এজন্য ইদানীং মনের কষ্টে গান বেঁধেছি :
“তুমি কি দেখেছ কভু বাংলা ফিল্মের পরাজয়
ভালো ছবির অভাবে অবস্থা যে করুণ
তিলে তিলে বাংলাফিল্মের ক্ষয় ।
আমি তো দেখছি ভালো ছবির অভাবে কত যে প্রতিভাময়ী তারকা অকালেই ঝরে যায় ।
শুকনো পাতার মর্মরে রূপ নিয়েছে বাংলা ফিল্ম
কত সুর বেদনায় ।
আজ স্টুডিও আর সিনেমা হলে নিষ্ফল আশা হাহাকার হয়ে রয় ।
ভালো ছবির অভাবে অবস্থা যে করুণ
তিলে তিলে বাংলা ফিল্মের ক্ষয় ।
প্রতি সপ্তাহে কত ফিল্ম মুক্তি পায়
কাগজের পাতায় এখন আর খবর হয় না টাকার অভাবে
রয়ে যায় অগোচরে ।
কেউ দেখেও ফিরে দেখে না সিনেমা হলের পানে ভুলেও তাকায় না ।
ভালো ছবি হয় না বলে কত সিনেমা প্রেমিক
দূরে সরে চলে গেছে ।
সিনেমায় কত তারকা তাদের কত অভিনয় নাচগান কারো মনে যেন আর দাগ কাটে না ওরা ।
কোনো তারকা যে হয় না এখন সবার প্রিয় ।
ভালো ছবির অভাবে অবস্থা যে করুণ
তিলে তিলে বাংলা ফিল্মের ক্ষয়…।”


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: JPHOSTBD