শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:০৯ পূর্বাহ্ন

কলকাতার গাড়ি বারান্দা এবং পঙ্কজকুমার মল্লিক

কলকাতার গাড়ি বারান্দা এবং পঙ্কজকুমার মল্লিক

১৮২৭ সালে কলকাতায় পালকি বাহকদের ধর্মঘট প্রায় এক মাস স্থায়ী হয়েছিল। এই ধর্মঘটে ইংরেজ প্রশাসন ও অভিজাত লোকেরা বেশ বিপাকে পড়েছিলেন। অবশেষে পালকি বাহকদের দাবির কাছে ইংরেজ সরকার নমনীয় হতে বাধ্য হয়।
ইতিমধ্যে একটি মজার ঘটনা ঘটে গেল। পালকির অভাবে তিনদিন ধরে অপিসে না যেতে পেরে জনৈক ব্রাউন সাহেবের ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটল । সহসা তার মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেল। তিনি মিস্ত্রী ডাকিয়ে একটা পাল্কির হাতলগুলো খুলিয়ে ফেললেন ও তলায় দু’টো চাকা লাগিয়ে দিলেন এবং সামনে জুড়ে দিলেন ঘোড়া। কলকাতার রাস্তায় চালু হলো ঘোড়ার গাড়ি। সাধারণ লোকেরা এর নাম দিলেন “পালকি গাড়ি”। সাহেবরা স্রষ্টার নামানুসারে এর নাম দিলেন ‘ব্রাউনবেরি’ গাড়ি।
পালকি ধর্মঘট অবশেষে মিটল। কিন্তু, চার পাঁচ বছরের মধ্যেই শহর ছেয়ে গেল ঘোড়ার গাড়িতে । এই ধর্মঘট কলকাতার গতি আরো বাড়িয়ে দিল। কলকাতা প্রবেশ করল অশ্বযানের যুগে।
কলকাতার বাবুরাও অনেকেই ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার শুরু করে দিলেন। কিন্তু এতে একটা অসুবিধা দেখা দিল। এতদিন পর্যন্ত পালকি করে বাবুরা বাড়ির অন্দরমহল পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারতেন। এখন ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহারের ফলে বাবুদের “বাবুত্ত্ব” নষ্ট হতে বসলো। কারণ, তাদের এখন রাস্তার ধূলো মাটি পাড়িয়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করতে হচ্ছে। এতে অনেক মোসাহেব বাবুর মানহানি হচ্ছে বলে মন্তব্য করতে শুরু করল। তারা বলতে লাগলো, বাবু এখন রাস্তার বাবু হয়ে গেছেন। বাবুর গায়ে বর্ষার জল, গ্রীষ্মের রোদ সবই লাগছে, ইত্যাদি ইত্যাদি । তাই বাবুর ইজ্জতের মাথা ঢাকতে ঘোড়ার গাড়ির মাথায় আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করা হ’ল এবং বাড়ির সদর দরজার সামনে নতুন বারান্দা তৈরী করা হল, যেখানে এসে বাবুর গাড়ি এসে দাঁড়াবে — এর নাম হয়ে গেল গাড়ি বারান্দা
কলকাতার রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ির সংখ্যা হু হু করে বেড়ে গেল, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল গাড়ি বারান্দাও। এখন, রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে মিউনিসিপ্যালিটি এই গাড়ি বারান্দাগুলোর জন্য বাঁধার সম্মুখীন হল। অতঃপর ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে আইন পাশ করা হল, নতুন করে আর কোনো গাড়ি বারান্দা তৈরী করা যাবে না।
কালক্রমে ঘোড়ার গাড়ির যুগ পেরিয়ে কলকাতা মোটর গাড়ির যুগে প্রবেশ করল। বিংশ শতাব্দীর দোরগড়ায় এসে কলকাতা হারিয়ে ফেলল তার বাবুযুগ, সেইসঙ্গে হারিয়ে গেল গাড়ি বারান্দার অতীত গৌরব। পরবর্তী কালে গাড়ি বারান্দাগুলো হয়ে উঠলো হকার এবং স্ট্রীট ফুডের দোকান, দরিদ্র আর ভবঘুরেদের আস্তানা এবং বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচানোর জন্য পথিকের আশ্রয়স্থল ।

বৃষ্টিভেজা এমনই এক গাড়ি বারান্দা থেকে আমারা পেয়েছিলাম বিখ্যাত এক কণ্ঠশিল্পীকে—পঙ্কজকুমার মল্লিক।
“আমার যুগ আমার গান” এ স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন, – “১৯২৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের একটা দিনে – এমনি বারি সেদিন ঝরেছিল কলকাতার সৌধমালা এবং জীর্ণ বস্তিগুলির শিরে — কোনমতে মালকোঁচা-মারা ধুতি ও শার্ট সামলাতে সামলাতে ক্যানিং ষ্ট্রীট বেয়ে সেন্ট্রাল আভিনিউয়ের মোড়ের কাছাকাছি এসেছি, — বৃষ্টি আবার ঝমঝমিয়ে নামল সতেজে । ওরই মধ্যে যতটা দ্রুত সম্ভব রাস্তা পার হয়ে একটা গাড়ি বারান্দার নীচে আশ্রয় নিলাম। মনুষ্য ও বৃষ মিলিয়ে সেখানে তখন অনেক আশ্রিত । আমি একটু স্বচ্ছন্দ হ’বার বাসনায় গাড়ি বারান্দার নীচে এক ডাক্তারবাবুর ডিসপেনসারির রোয়াকে উঠে দাঁড়ালাম। আমার মনে প্রাণে এল গানের আবেগ। — আমি গুনগুন করছিলাম – ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘন ঘোর বরিষায়’। হঠাৎ কে আমার পিঠে যেন টোকা মারল। চমকে মুখ ফিরিয়ে দেখি সাদা স্যুট পরা এক ভদ্রলোক। — আমায় বললেন, — ‘কাম ইন’।
ভিতরে যেতেই উনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বললেন, — ‘ আপনি গুনগুন করে খুব সুন্দর একটা গান করছিলেন । আমায় একটু শোনাবেন এখানে বসে?’ অনুরোধ শুনে একটু আড়ষ্ট হয়ে গেলাম । আমি অতি মৃদুস্বরে ও যথাসম্ভব দরদ দিয়ে পূর্বোক্ত গানটি তাঁকে গেয়ে শোনালাম – গান শুনে তো উনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘ডু ইউ লাইক টু ব্রডকাস্ট? কলকাতায় রেডিয়ো ষ্টেশন হয়েছে, ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি, আমার জানাশোনা আছে। যদি গাইতে চান তো বলুন’। — আমি অপ্রত্যাশিত এই অনুগ্রহে উদগ্রীব হয়ে বললাম, ‘আমায় যদি এ সুযোগ করে দেন তো কৃতার্থ হব’। — ডাক্তারবাবু সযত্নে আমার নাম ও ঠিকানা লিখে রাখলেন । আমি সবিনয়ে তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন – ডাঃ রামস্বামী আয়েঙ্গার’।
এর সপ্তাহ দুয়েক পরে একদিন আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমাদের বাড়ির সামনে একটা পালকি গাড়ি এসে দাঁড়ালো এবং সেই গাড়ি থেকে নামলেন স্বয়ং ডাঃ রামস্বামী আয়েঙ্গার। আমি তো বিহ্বল হয়ে ছুটে গিয়ে তাঁকে আপ্যায়ন করলাম। তিনি বললেন, চলুন আমার সঙ্গে। ওঁর সঙ্গে গিয়ে হাজির হলাম টেম্পল চেম্বার্সের বাড়িতে, তখন সেখানে বেতারের অফিস ও স্টুডিও।
২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৯২৭ খ্রীস্টাব্দের ওই দিনটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় শুভদিন। সেদিন সন্ধ্যাতেই আমি আমার প্রথম বেতার অনুষ্ঠান করেছিলাম, বিশ্বকবির সেই অপূর্ব গানখানি গেয়ে যে গানখানি সেদিন ডাঃ রামস্বামীকে শুনিয়েছিলাম, অর্থাৎ কবিগুরুর ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘন ঘোর বরিষায়’ ।
— স্বপন দাশগুপ্ত।

তথ্যসূত্র এবং কৃতজ্ঞতা : কলকাতার গাড়ি বারান্দা – হরিপদ ভৌমিক ।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD