বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০১:০১ অপরাহ্ন

আমার এই জীবন_যাপন – লুনা রাহনুমা

আমার এই জীবন_যাপন – লুনা রাহনুমা

শিশু সমাচার – কানের ওয়েক্স

খুব ছোটবেলা থেকে, বলা যায় দুই বছর বয়স থেকেই লক্ষ্য করতাম অচিরা খেলার সময় ছোটখাটো যা কিছু পায় নিজের নাকের ফুটোয় আমার কানের ফুটোয় ঢুকাতে থাকে। আমাদের বসার ঘরে ফায়ার প্লেসের সামনে কিছু আর্টিফিশিয়াল পাথরের মতো আছে, কালো রং করে কয়লা বানানো। অচিরা সেগুলোকে আছাড় দিয়ে ভাঙতো আর ছোট অংশগুলোকে নাকে ঢুকাতো। প্রায় সময়ই আমি তার নাক থেকে তুলো, সুতা, ছেঁড়া কাগজ এই সব বের করে পরিষ্কার করতাম। প্রায় সময় হাচি দিলে বেরিয়ে আসতো নানান জিনিস পত্র। এখন সাত বছর বয়স হয়েছে। এখন আর নাকে কিছু দেয় না। কিন্তু টিভি দেখতে দেখার সময় টিস্যু পেপার, কলম, পেন্সিল, অথবা হাতের কাছে চিকন চাকন যা কিছু থাকে, সেগুলো দিয়ে খোঁচানোর চেষ্টা করে।

কয়েকমাস আগে রাতে বিছায়ায় দিয়ে আমি ওর ডান কানের ভেতরে দেখি, এমনিতেই। পরিষ্কার দেখলাম কানের ভেতরে কিছু আছে।
জিজ্ঞেস করলাম, কানে কী?
অচিরা বললো, জানি না। কানে শব্দ করে।
কেমন শব্দ করে।
অচিরা মুখের ভেতর টুক টুক শব্দ করে দেখালো, এমন করে। সব সময় এমন শব্দ করে।

অচিরাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার বললো, কানের ভেতর কোন ফরেইন অবজেক্ট নেই। কিন্তু কানে অনেক ওয়েক্স জমেছে। নিয়মিত অলিভ অয়েল ড্রপ দিতে হবে। কানের ওয়েক্স আপনাআপনি বের হয়ে যাবে।

বললাম, হাসপাতালে নিয়ে গেলে তারা বের করে দিতে পারবেন না?

ডাক্তার জানালো, তার বয়স অনেক কম। এখন মেশিন দিয়ে টেনে পরিষ্কার করতে গেলে সেটা ওর কানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

আমরা অচিরার কানে অলিভ অয়েল ড্রপ দিয়ে যেতে থাকি। সপ্তাহ তিন পর, মনে হলো অল্প কিছু ওয়েক্স বের হয়েছে। কানের ভেতরে তখন গোল্লা মতো ময়লা দেখা যায়। আরো কয়েক সপ্তাহ অলিভ অয়েল দিতে থাকার পর একদিন সকালে ঘুম ভেঙে অচিরা দৌড়ে এলো, মা দেখো এইটা বের হৈছে আমার কান থেকে।

বেশ বড় এক দলা ওয়েক্স। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক, কানের ঝামেলা শেষ হয়েছে। কিন্তু শেষ বলে কোন কথা নাই। কয়েক সপ্তাহ পর, অচিরা স্কুলে যাবার কিছুক্ষণ আগে জানালো, সে কানে টিস্যু পেপার ঢুকিয়েছে। আমি চেক করে দেখলাম, ডান কানে গোল একটা টিস্যু বল দেখা যাচ্ছে। বের করার উপায় নেই। জিপিতে ফোন করলাম। বললো, ওকে হাসপাতালে একসিডেন্ট এন্ড ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলে তারা কান থেকে টিস্যু পেপার বের করে দেবে। স্কুল থেকে আসার সাথে সাথে নিয়ে গেলাম অচিরাকে হাসপাতালে। ডাক্তার সহজেই বের করে আনলো ওর কানের ভেতরে থাকা পেপারটুকু। তবে বললো, কানে এখনো কিছু ইনটেকড ওয়েক্স আছে। সেগুলো বের করার জন্য জিপিতে ফোন করে অচিরাকে আবার হাসপাতালে নিতে হবে।

পরদিন ফোন করে জিপিতে গেলাম। জিপির ডাক্তার অচিরার কানে লাইট ফেলে দেখে চমকে গেলো একটু। বিড়বিড় করে বললো, দেখে ভালো মনে হচ্ছে না।
আমি বললাম, ভালো না মানে কী?
মনে হচ্ছে কানে ফরেইন অবজেক্ট আছে।
নিশ্চিত হবার জন্য ডাক্তার পাশের রুম থেকে আরেকজন ডাক্তারকে ডেকে আনলো। সেও দেখে জানালো, কানের ভেতরে অবস্থিত জিনিসটুকু খুব কালো কিছু একটা। সেটা ওয়েক্স হবার কোনোই সম্ভাবনা নেই। অচিরার ডান কানের প্রায় পুরোটাই ব্লক হয়ে আছে। হাসপাতালে গেলে তারা এটি বের করে আনতে পারবে। জিপির ডাক্তার কিছুটা বিরক্ত হলো আগের দিনের ইমার্জেন্সির ডাক্তারের উপর। সে ইচ্ছা করলে সেদিনই ফরেন অবজেক্টটি বের করে দিতে পারতো। কিন্তু সে কথা এখন আর বলে লাভ নাই। তাই আমরা অপেক্ষা করি হাসপাতালের এপয়েন্টমেন্টের জন্য।

আমাদের পরিচিত কয়েকজনের সাথে কথা বললাম যারা বাচ্চার সমস্যা নিয়ে জিপি আর হাসপাতালের এইসব দীর্ঘমেয়াদি অপেক্ষায় থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী আমি প্রতিদিন হাসপাতালে ফোন করতে থাকি। তিন দিন চেষ্টা করে কথা বলতে পারলাম একজনের সাথে। সে অচিরার সব ইনফরমেশন রেখে জানালো ডাক্তার কল করে কথা বলবে। সেইদিনই কিছুক্ষন পর ডাক্তারের কল এলো। সব শুনে বললো, অচিরাকে আবার জিপিতে নিয়ে যেতে হবে। জিপির ডাক্তার ফরেইন অবজেক্টের ব্যাপারটি কমফার্ম করলে তাকে হাসপাতালে এপয়েন্টমেন্ট দেয়া হবে।

জিপিতে নিয়ে যাবার পর আর বেশি দেরি হলো না। পাঁচ দিনের মাথায় হাসপাতালে এপয়েন্টমেন্ট পেয়ে গেলাম। কোভিডের কারণে হাসপাতালে এখন মানুষজন অনেক কম মনে হলো। ইএনটি ডাক্তার এবং নার্স দুজনই খুব হাসিখুশি মানুষ। প্রথমে কিছুক্ষণ অচিরার সাথে গল্প করলো। কানের ঘটনা শুনলো মন দিয়ে। অচিরা মনে হলো খুবই খুশি হাসপাতালে যেতে পেরে। কানের ভেতর থেকে অব্জেক্টটি বের করে আনার মেশিনটি হাতে নিয়ে ডাক্তার অচিরার হাতে দিলো। বললো, “এটা হচ্ছে তোমার বাড়ির হুভারের মতো। হুভার দিয়ে যেমন ময়লা পরিষ্কার করা হয়, এই ছোট্ট পাইপটা তোমার কানে দিয়ে কানের ভেতরের ময়লাগুলো বের করে আনবো আমি।”

ডাক্তার অচিরার হাতে মেশিনটি চালিয়ে দেখালো। কয়েক মিনিটে দুই কান পরিষ্কার করে ফেললো। অচিরা খুব গুড গার্লের মতো ছিল। একদম নড়াচড়া করেনি। আর সমস্যাজনক ডান কান থেকে বের হয়েছে কালো প্লাস্টিকের পুতি বা খেলনার কোন ভাঙা অংশ হবে। নার্স অচিরাকে একটি স্টিকার দিলো আসার সময়। খুব খুশি অচিরা জানায়, সে আবার হাসপাতালে যেতে চায়। কানের ভেতর হুভার দিয়ে পরিষ্কার করাটা তার খুব পছন্দ হয়েছে।

অক্টোবর ২০২১

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD