শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২২ অপরাহ্ন

অ্যালান টুরিং ও আরেক ধরনের সংখ্যালঘুরা –

অ্যালান টুরিং ও আরেক ধরনের সংখ্যালঘুরা –

অ্যালান টুরিং

✍️ Madhusree Bandyopadhyay

অ্যালান টুরিং ও আরেক ধরনের সংখ্যালঘুরা –

অ্যালান টুরিং আত্মহত্যা করেছিলেন। ৭ই জুন, ১৯৫৪ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে টুরিং তার প্রযুক্তিগত মেধার সাহায্যে জার্মানির কোড ভেঙে সাহায্য করেছিলেন নিজের দেশ ইংল্যাণ্ডের যুদ্ধ জয়ে। সেই ইংল্যাণ্ড বিশ্বযুদ্ধত্তোর কালে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ, নিজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানকে সমকামিতার দায়ে রাসায়নিক উপায়ে খোজাকরণ করে।

ওই পদ্ধতি শেষ হবার পরে টুরিং আত্মহত্যা করেন।

টুরিং ছিলেন গণিতজ্ঞ, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অন্যতম জনক, তাত্ত্বিক জীববিজ্ঞানী। এবং আধুনিক কম্পিউটারের জনক।

সমকামিতা কী মানুষের কোন অস্বাভাবিকতা? প্রকৃতির সংখ্যালঘু অংশের মধ্যে সমকামিতা নিয়মিতভাবে চলে আসছে। জিরাফ, বাইসন, সিংহ, ডলফিন, বনোবো, রাজঁহাস, ভেড়া এরকম অজস্র পাখি ও পশুর মধ্যে সমকামিতা দেখা গেছে। ৮% ভেড়া স্বাভাবিক ভাবে সমকামি। তার জন্য অবশ্য ভেড়াদের খোজাকরণ করা হয় না। কারণ ওদের জন্য ধর্মীয় নির্দেশ আসে না। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণ বলিপ্রদত্ত হয় না।

ভারতবর্ষে সমকামিতা ডিক্রিমিনালাইজ করা হয়েছে দু বছর আগে। ঊনবিংশ শতক থেকে এই দেশে সমকামিতা ছিল আইনত অপরাধ। কারণ সমকামিতা নাকি “against the order of nature”।

এই আইন ভারতবর্ষে প্রয়োগ করেছিল ব্রিটিশরা। অথচ আমাদের দেশের মন্দিরে, খাজুরাহ ও কোনারকে, কামসূত্র গ্রন্থে সমকামিতা স্বীকৃত ছিল। আমার বা আপনার তা পছন্দের যৌন অভ্যাস না হতে পারে, কিন্তু কিছু মানুষের এটাই স্বাভাবিক পছন্দের যৌন অভ্যাস। এক সময়ে এই কথা সমাজ পরিচালকরা মেনে নিয়েছিলেন। প্রাচীন যুগে, এমনকি মধ্য যুগেও। সমকামিতার গণ্ডা গণ্ডা উদাহরণ আছে মধ্য যুগে।

তবে গোষ্ঠীবদ্ধ ধর্ম সাধারণভাবে সমকামিতার বিরুদ্ধে। কারণ সমকামিতা সন্তানের জন্ম দিতে পারে না। আর ধর্ম চায় দলের বৃদ্ধি। তাই যে সেই অবিরাম জন্মদানের নিয়ম শারীরিক ও মানসিক কারণ বশতঃ মানতে রাজি নয়, তাকে ভয়ঙ্কর শাস্তি দিয়ে অন্যদের জন্য উদাহরণ তৈরি করে ধর্ম।

ধর্ম ও রাষ্ট্র মিলিতভাবে কিছু মানুষের প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকে পাল্টে দিতে চায়। আজকে বহু মা-বাবা সমাজের চাপে, ভয়ে, লজ্জায়, অপমানিত হবার আশঙ্কায় সন্তানের যৌন অভ্যাস পাল্টে দেবার জন্য ডাক্তারদের সাথে পরামর্শ করেন। অবশ্য এব্যাপারে রামদেবের ওষুধ নাকি অব্যর্থ, কোভিদ-১৯ এর ওষুধের মত।

আমাদের সমাজ বিদেশি সমাজকে প্রতিবিম্বিত করতে গিয়ে নিজেদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থাকে ভুলে গেছে।

তবে শুধু যৌন অভ্যাস নয়, যৌনতা ব্যাপারটাই ভিক্টরীয় সংস্কৃতির পাল্লায় পরে একদিকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখা হয়, অন্যদিকে তাই নিয়ে আঁশটে চর্চার বন্যা বয়ে যায়। খবরের কাগজে দেখবেন, অর্ধেক পাতা থাকে এই ধরনের যৌনতা বিষয়ক গ্রাম্য পরচর্চামূলক চুটকিতে।

একটা উদাহরণ দেই। বহুগামিতাকে সমাজ শৃঙ্খলাবদ্ধ করেছে, বিশেষতঃ নারীর বহুগামিতায় বেড়ি পরানো হয়েছে অনেক দিন আগে।

আগে মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে থাকত। তারপরে সে শিখে নিল কৃষিকাজ। এল পরিবার। এল ব্যক্তিগত সম্পত্তি। দুটো ধানের গোলা, তিনটে ছাগল। এখন কে পাবে এই ব্যক্তিগত সম্পদ?
নির্দিষ্ট পুরুষের স্পার্ম থেকে জন্ম নেওয়া আরেক পুরুষের হাতে যাবে ওই সম্পত্তি। ব্যক্তিগত মালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিত রাখতে হবে। নারীর বহুগামিতা ওদের তৈরি নিয়মের বিরোধী। সেই সময়ে, এই ৫-৭ হাজার বছর আগে, পৃথিবীতে ধীরে ধীরে রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিকশিত হচ্ছে। রাষ্ট্র নিয়ম করে নারীর বহুগামিতা নিষিদ্ধ করল।

তাই কৃষ্ণ হতে পারে বহুপত্নীক। তবে শ্রীরাধিকে কলঙ্কিনী।

বিভিন্ন দেশে এই সেদিন পর্যন্ত ক্ষমতাধর পুরুষ বহুগামিতা চালিয়েছে। ভারতের হিন্দু রাজন্য, বাঙালি কুলীন ব্রাহ্মণ, অটোম্যান ও মুঘল হারেম, চীনের সম্রাটের গণিকা বাহিনী, ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ডেরর রাজন্যবর্গ সামান্য কিছু উদাহরণ মাত্র। আজও ইসলাম ধর্মে কিছু দেশে পুরুষের বহু বিবাহ স্বীকৃত। একদিন এই আচার ছিল সমগ্র পৃথিবী জুড়ে।

ক্যাথলিক ধর্ম পুরুষের বহুগামিতাতে বেড়ি পড়াতে চেষ্টা করে। তবে ক্ষমতাধর তা মানবে কেন? তাই ইংল্যাণ্ডে অষ্টম হেনরি ধর্ম ভেঙে, আইন পাল্টে নিজেই ধর্ম তৈরি করে নিলেন। বহুগামিতার অভিযোগে স্ত্রীকে খুন করে প্রমোদে ঢেলে দিলেন মন ও প্রাণ।

ধর্ম তখন ঠুঁটো জগন্নাথ।

সেই অষ্টম হেনরীর বংশধরের আমলে টুরিংকে খোজাকরণ করা হয়। আবার এই সেদিন একই রাজন্য বর্গ অ্যালান টুরিংকে ‘রাজকীয় ক্ষমা’ প্রদর্শন করে – তার সমকামিতার জন্য।
এই নির্লজ্জতা ও ভণ্ডামি দেখলে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়।

প্রায় সকল পশু ও প্রাণী বহুগামী। মানুষও প্রকৃতিগত ভাবে বহুগামী। একগামিতা এসেছে সম্পত্তির মালিকানা ঠিক করতে। পরে চাপে পড়ে পুরুষের বহুগামিতাও নিষিদ্ধ হয়।
তবে এই সমস্ত নিয়ম ও নিষেধ সাময়িক। বিবাহ বিচ্ছেদের উল্কাসম গতি বুঝিয়ে দিচ্ছে মানুষ প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের বিরুদ্ধে যেতে চায় না।

আমরা আছি এক অস্থায়ী অন্তর্বর্তী সমাজে।

একদিন এই সমাজ থাকবে না। বিদেশে যেমন স্বাভাবিক নিয়মে বিচ্ছেদের পরে সম্পত্তি বিভক্ত হয়ে যায়, সন্তানরা মা ও বাবার কাছে নিয়মমাফিক বিভক্ত হয়ে বাস করে, তেমনই একদিন সকল দেশেই হবে। গোলা-গুলি ছাড়াই সমাজ এই পরিবর্তন মেনে নেবে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণিত সমাজ একদিন আসবে।

সেই অন্তর্বর্তী সময় পর্যন্ত আসুন আমরা একটু সহানুভূতি দেখাই, হাতটা ধরি ভিন্ন ধর্মীদের, সাহসী কিছু মানুষের। সামাজিক সংখ্যালঘুদের।

যতবার আমি টুরিং এর কথা পড়েছি, ততবার তার জন্য নিঃশব্দে কেঁদেছি।

এত প্রতিভা, এত বেদনা, এত যন্ত্রণা, এত হেনস্তা, এত ভয়াবহতা এক অতি প্রতিভাবান মানুষ একই জীবনে ভোগ করেছেন।

বিনা দোষে ও বিনা কারণে।

আসলে মানুষের সমষ্টিগত অবিশ্বাস্য মূর্খতার কারণে।

Madhusree Bandyopadhyay
08/06/2021

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD