গবেষকদের চোখে ২০৫০ সালের মহাকাশ
২০৫০ সালের মধ্যে মহাকাশে আমাদের আমাদের উপস্থিতি কতটা বাড়বে?
চাঁদের বুকে তৈরি হতে পারে মানুষের কলোনি, সেখান থেকে নিয়মিত খনিজ পদার্থও সংগ্রহ শুরু হয়ে যেতে পারে। পর্যটকদের জন্য তৈরি হয়ে যেতে পারে পৃথিবীর কক্ষপথ কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা ভাসমান সব রিসোর্ট।
মহাকাশে আয়োজিত হতে পারে বিভিন্ন খেলাধুলার ইভেন্ট কিংবা নির্মিত হতে পারে বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ভবিষ্যতের দামি আর জনপ্রিয় কফি বিনের চাষও হতে পারে মহাকাশেই।
এসব বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মত শোনালেও সম্প্রতি গবেষকরা ভবিষ্যতের এমন চিত্রের ব্যাপারেই ধারণা করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক এবং গবেষণা কেন্দ্র ‘র্যান্ড কর্পোরেশন’ (RAND Corporation) এর ইউরোপ অংশের গবেষকরা ২০৫০ সালের মধ্যে মহাকাশে অর্থনীতির কোন সব ক্ষেত্র বিকশিত হতে পারে, তার পূর্বাভাস দিয়েছেন। এজন্য তারা মহাকাশে এক ডজনেরও বেশি শিল্প ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ব্যাপারে বিবেচনা করেছেন।
তবে এই গবেষণার মাধ্যমে আগামীতে মহাকাশে কী ঘটবে বা কী ঘটা উচিৎ, সে সম্পর্কে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসা হয়নি। বরং আসন্ন তিন দশকের মধ্যে মহাকাশে কী কী ঘটতে পারে, তার সম্ভাবনা নিয়ে অনুমান করা হয়েছে।
এই গবেষণায় অর্থায়ন করেছে যুক্তরাজ্যের মহাকাশ সংস্থা ‘ইউকে স্পেস এজেন্সি’। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের মহাকাশে কোন ক্ষেত্রে ঝুঁকি এবং কোন ক্ষেত্রে লাভের সম্ভাবনা রয়েছে, সেটাই বোঝার চেষ্টা করেছে যুক্তরাজ্য।
গবেষণা থেকে পাওয়া ফলাফল মহাকাশ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে দেশটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরি করতে কাজে লাগবে, এমনটাই জানানো হয়েছে গবেষণায়।
গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে যে, অদূর ভবিষ্যতেই মহাকাশ ভ্রমণ কিংবা মহাকাশ কেন্দ্রিক অন্যান্য কার্যক্রম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক বড় একটা অংশ হয়ে উঠবে। আর এমনটা হওয়ার জন্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতির প্রয়োজন হবে না।
বরং এখন যেই হারে প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে, তেমনটা বজায় থাকলেই এমন ভবিষ্যৎ দেখব আমরা। হতে পারে নির্দিষ্ট কোনো উদ্ভাবন বা কোনো প্রযুক্তির উন্নতি ঘটলে মহাকাশ ভিত্তিক এই উন্নয়নের গতি হঠাৎ বেড়ে যাবে।
সম্প্রতি গত কয়েক বছরের মধ্যেই মহাকাশে মানুষ কিংবা মালামাল পাঠানোর খরচ অনেক কমে এসেছে।
অবশ্য পৃথিবীর বাইরে এক কেজি ওজনের কিছু পাঠাতে এখনো কয়েক হাজার ডলার খরচ হয়। কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে খরচের এই পরিমাণ ২০৪০ সালের মধ্যেই ১০০ ডলারের নিচে নেমে আসবে। আর এমনটা ঘটলে শুধু খরচের জন্য মহাকাশের বুকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আটকে থাকবে না।
অদূর ভবিষ্যতে মহাকাশ কেমন হবে, তা নিয়ে নানান দেশের সরকার, সামরিক কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন শিল্প এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই প্রচুর প্রতিবেদন এবং নথি প্রকাশ করেছে। সেসব প্রতিবেদনে বিভিন্ন আঙ্গিকেই মহাকাশ নিয়ে তাদের লক্ষ্য, অনুমান এবং সম্ভাবনা উঠে এসেছে।
ফলে ভবিষ্যতের ব্যাপারে ধারণা পাওয়ার জন্য র্যান্ড কর্পোরেশনের গবেষকদের উদ্ভট কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করতে হয়নি। বরং বিশ্বাসযোগ্য বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া এসব তথ্য থেকেই তারা ২০৫০ সালের মহাকাশের চিত্র কল্পনা করেছেন।
চাঁদ বা মহাকাশে থাকা বিভিন্ন গ্রহাণু থেকে মূল্যবান খনিজ উপাদান সংগ্রহের প্রতিযোগিতা শুরু হলে মহাকাশ ভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প বিকশিত হওয়া শুরু হবে। সম্ভাবনা রয়েছে আগামী এক দশকের মধ্যেই শুরু হবে মহাকাশ থেকে খনিজ পদার্থ আহরণের দৌড়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেটাই হয়ে উঠতে পারে ‘২১ শতকের গোল্ড রাশ’।
মূলত নতুন আবিষ্কৃত কোনো স্বর্ণক্ষেত্রের আশেপাশের এলাকায় মানুষের দ্রুত আগমনকে বোঝাতে ইংরেজি ‘গোল্ড রাশ’ কথাটা ব্যবহৃত হয়।
বিশেষ করে উনিশ শতকের বিভিন্ন সময়ে ক্যালিফোর্নিয়া সহ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং কানাডায় নতুন খুঁজে পাওয়া স্বর্ণক্ষেত্রে ভাগ্য ফেরানোর আশায় থাকা প্রচুর মানুষ ভিড় জমায়। আর সেসব ঘটনার কথা বোঝাতেই বলা হয় ‘গোল্ড রাশ’।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মহাকাশ থেকে খনিজ পদার্থ আহরণ শুরু হলে উনিশ শতকের ‘গোল্ড রাশ’ এর বিভিন্ন ঘটনার মত মহাকাশেও মানুষের আনাগোনা বেড়ে যাবে।
তাছাড়া মহাকাশে দীর্ঘমেয়াদে খনি কার্যক্রম চালাতে পরিবহন, সরবরাহ এবং মেরামত সংক্রান্ত কাজ করা লাগবে। আর সেজন্য নিয়মিত পৃথিবীর বাইরে মানুষের যাতায়াতের প্রয়োজন হবে। এমন প্রচলন শুরু হলে মহাকাশে বিভিন্ন শিল্প-কারখানাও স্থাপিত হতে পারে। কারণ সেখানে বায়ু দূষণ কোনো উদ্বেগের বিষয় হবে না।
এদিকে বড় আকারে স্থাপিত খনি এবং কারখানা চালানোর জন্যও শক্তির নতুন উৎস প্রয়োজন হবে। আর তখন উন্নত রাষ্ট্রগুলি মহাকাশ-ভিত্তিক সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে গবেষণায় এগিয়ে যেতে পারবে।
এসব কেন্দ্র থেকে পরিবেশবান্ধব উপায়ে উৎপন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তি বা লেজার ট্রান্সমিটার।
তবে এসব কিছু বাস্তবায়িত হওয়ার জন্যে আরো বেশি মানুষকে মহাকাশে যেতে হবে, সেখানে কাটাতে হবে দীর্ঘ সময়। ফলে তৈরি হবে মহাকাশে থাকা মানুষদের জন্য হোটেল স্থাপনের প্রয়োজনীতা। আর ভবিষ্যতে এসব হোটেলই হয়ে উঠতে পারে সাধারণ মানুষের পর্যটন গন্তব্য।
এভাবে মহাকাশে মানুষের যাতায়াত বাড়লে চালু হতে পারে নতুন সব পরিবহন ব্যবস্থা। আসতে পারে তড়িৎচৌম্বকীয় প্রযুক্তিতে চলা ম্যাগনেটিক স্পেস ট্রেন। এসব ট্রেন দিয়ে অনেক দূরের রিসোর্ট বা হোটেল থেকে কারখানা পর্যন্ত যাতায়াত করা যাবে অনেক কম সময়েই।
২০৫০ সালের মধ্যে মহাকাশে চিত্রগ্রহণ বা শ্যুটিং এর প্রচলনও স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে। এছাড়া জটিল এবং চমক জাগানো সব খেলাধুলার আয়োজনও হতে পারে সেখানে।
পৃথিবীর বাইরে চাঁদে বা অন্য কোথাও অবস্থিত খনির মানুষদের চাহিদা মেটানোর জন্য মহাকাশেই শুরু হতে পারে কৃষিকাজ। তবে পৃথিবীতে বসবাস করা মানুষদের কাছেও মহাকাশে চাষ হওয়া বিভিন্ন পণ্যের সমাদর তৈরি হতে পারে। আর এমন এক পণ্য হতে পারে মহাকাশে উৎপাদিত কফি বিন।
এদিকে মহাকাশ যাত্রা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে চলে আসার ক্ষেত্রে খরচই শুধু একমাত্র বাধা না। মহাকাশযানে চড়ে পৃথিবীর বাইরে যাওয়ার প্রক্রিয়া যাতে সময়ের সাথে সাথে আরো নির্ভরযোগ্য এবং নিরাপদ হয়ে ওঠে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে মহাকাশযানে প্রতিবার চড়ার সময়ই যাতে যাত্রীরা নিরাপদ বোধ করেন।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে আইন ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কঠিন কিছু প্রশ্নের সমাধান করতে হবে। যেমন, চাঁদ কিংবা চাঁদের বুকে থাকা বিভিন্ন সম্পদ আহরণের মালিকানা কোন দেশের দখলে কতটুকু থাকবে? কিংবা পৃথিবীর বাইরে কোথাও অপরাধ সংঘটিত হলে এর বিচার কীভাবে হবে?
পরিশেষে বলা যায়, ভবিষ্যতে মহাকাশ কেমন হতে পারে তা নিয়ে মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই কল্পনা করে এসেছে। আর গবেষকরাও স্বীকার করেছেন যে, ২০৫০ সালের মহাকাশের চিত্র তারা যেভাবে কল্পনা করেছেন, এর মধ্যে নতুন কিছু নেই। ১৯ শতকের শেষভাগ থেকে শুরু করে ২০ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং সায়েন্স ফিকশন লেখকদের অনেকেই এমন বাস্তবতার কথা ভেবেছেন।
#মহাকাশ #ভবিষ্যৎ #সম্ভাবনা
Leave a Reply